পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOve SR রবীন্দ্র-রচনাবলী রাজা বি. এ. পাস । তাহার কোনোপ্রকার উচ্চস্থলতা ছিল না। বড়োমানুষের ছেলে হইয়াও নিয়মিত সময়ে, এমন-কি, নির্দিষ্ট স্থানেই শয়ন ভোজন করিতেন । বিপিনকিশোরকে হঠাৎ তাহার নেশার মতো লাগিয়া গেল । তাহার গান শুনিতে ও তাহার রচিত গীতিনাট্য আলোচনা করিতে করিতে ভাত ঠাণ্ড হইতে থাকে, রাত বাড়িয়া যায়। দেওয়ানজি বলিতে লাগিলেন, তাহার সংযতস্বভাব মনিবের চরিত্রদোষের মধ্যে কেবল ঐ বিপিনকিশোরের প্রতি অতিশয় আসক্তি । রানী বসন্তকুমারী স্বামীকে তর্জন করিয়া বলিলেন, “কোথাকার এক লক্ষ্মীছাড়া বানর আনিয়া শরীর মাটি করিবার উপক্ৰম করিয়াহু, ওটাকে দূর করিতে পারিলেই আমার হাড়ে বাতাস লাগে।” রাজা যুবতী মীর ঈর্ষায় মনে মনে একটু খুশি হইতেন, হাসিতেন ; ভাবিতেন, মেয়েরা যাহাকে ভালোবাসে কেবল তাহাকেই জানে। জগতে যে আদরের পাত্র অনেক গুণী আছে, স্ত্রীলোকের শাস্ত্ৰে সে কথা লেখে না । যে লোক তাহার কানে বিবাহের মন্ত্ৰ পড়িয়াছে সকল গুণ তাহার এবং সকল আদর তাহারই জন্য । স্বামীর আধঘণ্টা খাবার সময় অতীত হইয়া গেলে অসহ্য হয়, আর, স্বামীর আশ্রিতকে দূর করিয়া দিলে তাহার একমুষ্টি অন্ন জুটিবে না, এ সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। স্ত্রীলোকের এই বিবেচনাহীন পক্ষপাতদূষণীয় হইতে পারে, কিন্তু চিত্তরঞ্জনের নিকট তাহা নিতান্ত অগ্ৰীতিকর বোধ হইল না । এইজন্য তিনি যখন-তখন বেশিমাত্রায় বিপিনের গুণগান করিয়া স্ত্রীকে খ্যাপাইতেন ও বিশেষ আমোদ বোধ করিতেন । এই রাজকীয় খেলা বেচারা বিপিনের পক্ষে সুবিধাজনক হয় নাই। অন্তঃপুরের বিমুখতায় তাহার আহারাদির ব্যবস্থায় পদে পদে কণ্টক পড়িতে লাগিল । ধনীগহের ভূত্য আশ্রিত ভদ্রলোকের প্রতি স্বভাবতই প্রতিকূল ; তাহারা রানীর আক্ৰোশে সাহস পাইয়া ভিতরে ভিতরে বিপিনকে অনেকপ্রকার উপেক্ষা দেখাইত । রানী একদিন পুঁটেকে ভৎসনা করিয়া কহিলেন, “তোকে যে কোনো কাজেই পাওয়া যায় না, সমস্ত क्रिन् कमि रुँको ।” সে কহিল, রাজার আদেশে বিপিনবাবুর সেবাতেই তাহার দিন কাটিয়া যায় । রানী কহিলেন, “ইস, বিপিনবাবু যে ভারি নবাব দেখিতেছি।” পরদিন হইতে পুঁটে বিপিনের উচ্ছিষ্ট ফেলিয়া রাখিত ; অনেকসময় তাহার অল্প ঢাকিয়া রাখিত না । অনভ্যন্ত হন্তে বিপিন নিজের অল্পের থালি নিজে মাজিতে লাগিল এবং মাঝে মাঝে উপবাস দিল ; কিন্তু ইহা লইয়া রাজার নিকট নালিশ ফরিয়াদ করা তাহার স্বভাববিরুদ্ধ । কোনো চাকরের সহিত কলহ করিয়া সে আত্মবিমাননা করে নাই। এইরূপে বিপিনের ভাগ্যে সদর হইতে আদর বাড়িতে লাগিল, অন্দর হইতে অবজ্ঞার সীমা রহিল না । এ দিকে সুভদ্ৰাহরণ গীতিনাট্য রিহার্শালশেষে প্ৰস্তুত । রাজবাটির অঙ্গনে তাহার অভিনয় হইল । রাজা স্বয়ং সাজিলেন কৃষ্ণ, বিপিন সাজিলেন অর্জন । আহা, অর্জনের যেমন কণ্ঠ তেমনি রূপ । দর্শকগণ “ধন্য ধন্য’ করিতে লাগিল । রাত্রে রাজা আসিয়া বসন্তকুমারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন অভিনয় দেখিলে ।” রানী কহিলেন, “বিপিন তো বেশ অর্জন সাজিয়াছিল। বড়োঘরের ছেলের মতো তাহার চেহারা বটে, এবং গলার সুরটিও তো দিব্য ।” রাজা বলিলেন, “আর, আমার চেহারা বুঝি কিছুই নয়, গলাটাও বুঝি মন্দ ?” । রানী বলিলেন, “তোমার কথা আলাদা।” বলিয়া পুনরায় বিপিনের অভিনয়ের কথা পাড়িলেন । রাজা ইহা অপেক্ষা অনেক উচ্ছসিত ভাষায় রানীর নিকট বিপিনের গুণগান করিয়াছেন ; কিন্তু অদ্য রানীর মুখের এইটুকুমাত্র প্রশংসা শুনিয়া ঠাঁহার মনে হইল, বিপিনটার ক্ষমতা যৌ-পরিমাণে অবিবেচক লোকে তদপেক্ষা তাহকে ঢের বেশি বাড়াইয়া থাকে । উহার চেহারাই বা কী, আর গলাই বা কী এমন । কিয়াৎকাল পূর্বে তিনিও এই অবিবেচকশ্রেণীর মধ্যে ছিলেন ; হঠাৎ কী কারণে র্তাহার বিবেচনা-শক্তি বাড়িয়া উঠিল।