পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ONტ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পরেশ পশ্চিমে একটি ক্ষুদ্র শহরে ওকালতি করিতেন ; ঘরে আমীয়স্বজন বড়ো কেহ ছিল না, একাকিনী স্ত্রীর জন্য র্তাহার চিত্ত উদবিগ্ন হইয়া থাকিত। মাঝে মাঝে এক-একদিন হঠাৎ অসময়ে তিনি আদালত হইতে বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইতেন। প্ৰথম প্ৰথম স্বামীর এইরূপ আকস্মিক অভু্যদয়ের কারণ গৌরী ঠিক বুঝিতে পারিত না । মাঝে মাঝে অকারণ পরেশ এক-একটা করিয়া চাকর ছাড়াইয়া দিতে লাগিলেন । কোনো চাকর তাহার আর দীর্ঘকাল পছন্দ হয় না। বিশেষত অসুবিধার আশঙ্কা করিয়া যে চাকরকে গীেরী রাখবার জন্য অধিক আগ্ৰহ প্ৰকাশ করিত, তাহাকে পরেশ এক মুহুর্ত স্থান দিতেন না। তেজস্বিনী গৌরী ইহাতে যতই আঘাত বােধ করিত স্বামী ততই অস্থির হইয়া এক-এক সময়ে অদ্ভুত ব্যবহার করিতে থাকিতেন । অবশেষে আত্মসংবরণ করিতে না পারিয়া যখন দাসীকে গোপনে ডাকিয়া পরেশ নানাপ্রকার সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন তখন সে-সকল কথা গৌরীর কর্ণগোচর হইতে লাগিল । অভিমানিনী স্বল্পভাষিণী নারী অপমানে আহত সিংহিনীর ন্যায় অন্তরে অন্তরে উদ্দীপ্ত হইতে লাগিলেন এবং এই উন্মত্ত সন্দেহ দম্পতির মাঝখানে প্ৰলয়খড়ের মতো পড়িয়া উভয়কে একেবারে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিল । গৌরীর কাছে তাহার তীব্ৰ সন্দেহ প্ৰকাশ পাইয়া যখন একবার লজ্জা ভাঙিয়া গেল, তখন পরেশ স্পষ্টতই প্ৰতিদিন পদে পদে আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়া স্ত্রীর সহিত কলহ করিতে আরম্ভ করিল এবং গৌরী যতই নিরুত্তর অবজ্ঞা এবং কশাঘাতের ন্যায় তীব্রুকটাক্ষ দ্বারা তাহাকে আপাদমস্তক যেন ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিল, ততই তাহার সংশয়মত্ততা আরো যেন বাড়িবার দিকে চলিল । এইরূপ স্বামীসুখ হইতে প্ৰতিহত হইয়া পুত্রহীনা তরুণী ধর্মে মন দিল । হরিসভার নবীন প্রচারক ব্ৰহ্মচারী পরমানন্দস্বামীকে ডাকিয়া মন্ত্র লইল এবং তাহার নিকট ভাগবতের ব্যাখ্যা শুনিতে আরম্ভ করিল । নারীহািদয়ের সমস্ত ব্যর্থ স্নেহ প্রেম কেবল ভক্তি-আকারে পুঞ্জীভূত হইয়া গুরুদেবের পদতলে সমৰ্পিত হইল । পরমানন্দের সাধুচরিত্র সম্বন্ধে দেশবিদেশে কাহারও মনে সংশয়মাত্র ছিল না। সকলে তাহাকে পূজা করিত। পরেশ ইহার সম্বন্ধে মুখ ফুটিয়া সংশয় প্রকাশ করিতে পারিতেন না বলিয়াই তাহা গুপ্ত ক্ষতের মতো ক্রমশ তাহার মর্মের নিকট পর্যন্ত খনন করিয়া চলিয়াছিল । একদিন সামান্য কারণে বিষ উদগীরিত হইয়া পড়িল । স্ত্রীর কাছে পরমানন্দকে উল্লেখ করিয়া 'দুশ্চরিত্র ভণ্ড' বলিয়া গালি দিলেন এবং কহিলেন, “তোমার শালগ্রাম স্পর্শ করিয়া শপথপূর্বক বলে। দেখি সেই বকধার্মিককে তুমি মনে মনে ভালোবাস না ।” দলিত ফণিনীর ন্যায় মুহুর্তের মধ্যেই উদগ্র হইয়া মিথ্যা স্পর্ধ দ্বারা স্বামীকে বিদ্ধ করিয়া গৌরী রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “ভালোবাসি, তুমি কী করিতে চাও করো।” পরেশ তৎক্ষণাৎ ঘরে তালাচাবি লাগাইয়া তাহাকে রুদ্ধ করিয়া আদালতে চলিয়া গেল । অসহ্য রোষে গৌরী কোনোমতে দ্বার উন্মোচন করাইয়া তৎক্ষণাৎ বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল । পরমানন্দ নিভৃত ঘরে জনহীন মধ্যাহ্নে শাস্ত্রপাঠ করিতেছিলেন । হঠাৎ আমেঘবাহিনী বিদ্যুল্লিতার মতো গৌরী ব্ৰহ্মচারীর শাস্ত্ৰাধ্যয়নের মাঝখানে আসিয়া ভাঙিয়া পড়িল । ९७द्रः कशिद्वान्, '@ कैी ।” শিষ্য কহিল, “গুরুদেব, অপমানিত সংসার হইতে আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া চলো, তোমার সেবাৱতে আমি জীবন উৎসর্গ করিব।” ۱ পরমানন্দ কঠোর ভৎসনা করিয়া গৌরীকে গৃহে ফিরিয়া পাঠাইলেন । কিন্তু, হায় গুরুদেব, সেদিনকার সেই অকস্মাৎ ছিন্নবিচ্ছিন্ন অধ্যয়ন সূত্র আর কি তেমন করিয়া জোড়া লাগিতে পারিল। পরেশ গৃহে আসিয়া মুক্তদ্বার দেখিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে কে আসিয়াছিল।” স্ত্রী কহিল, “কেহ আসে নাই, আমি গুরুদেবের গৃহে গিয়াছিলাম।” পরেশ মুহুর্তকাল পাংশু এবং পরীক্ষণেই রক্তবর্ণ হইয়া কহিলেন, “কেন গিয়াছিলে ।”