পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVV রবীন্দ্র-রচনাবলী বলয়ের এবং বলয়ের দ্বারা মণির শোভা বৃদ্ধি হয় তেমনি আমার মধ্যস্থতায় দারোগার এবং দারোগার মধ্যস্থতায় আমার উত্তরোত্তর আর্থিক শ্ৰীবৃদ্ধি ঘটিতেছিল। এই-সকল ঘনিষ্ঠ কারণে হাল নিয়মের কৃতবিদ্যা দারোগা ললিত চক্রবতীর সঙ্গে আমার একটু বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল । তাহার একটি অরক্ষণীয়া আত্মীয়া কন্যার সহিত বিবাহের জন্য মাঝে মাঝে অনুরোধ করিয়া আমাকেও প্রায় তিনি অরক্ষণীয় করিয়া তুলিয়াছিলেন । কিন্তু, শশী আমার একমাত্র কন্যা, মাতৃহীনা, তাহাকে বিমাতার হাতে সমর্পণ করিতে পারিলাম না । বর্ষে বর্ষে নূতন পঞ্জিকার মতে বিবাহের কত শুভলগ্নই ব্যর্থ হইল। আমারই চোখের সম্মুখে কত যোগ্য এবং অযোগ্য পাত্র फिनिशी ऊनिळ्ला | শশীর বয়স বারো হইয়া প্ৰায় তেরোয় পড়ে। কিছু সুবিধামত টাকার জোগাড় করিতে পারিলেই মেয়েটিকে একটি বিশিষ্ট বড়োঘরে বিবাহ দিতে পারিব, এমন আশা পাইয়াছি । সেই কর্মটি শেষ করিতে পারিলে অবিলম্বে আর-একটি শুভকর্মের আয়োজনে মনোনিবেশ করিতে পারিব । সেই অত্যাবশ্যক টাকাটার কথা ধ্যান করিতেছিলাম, এমন সময় তুলসীপাড়ার হরিনাথ মজুমদার আসিয়া আমার পায়ে ধরিয়া কাদিয়া পড়িল । কথাটা এই, তাহার বিধবা কন্যা রাত্রে হঠাৎ মারা গিয়াছে, শত্ৰুপক্ষ গর্ভপাতের অপবাদ দিয়া দারোগার কাছে বেনামি পত্র লিখিয়াছে। এক্ষণে পুলিস সদ্য কন্যাশোকের উপর এতবড়ো অপমানের আঘাত তাহার পক্ষে অসহ্য হইয়াছে । আমি ডাক্তারও বটে, দারোগার বন্ধুও বটে, কোনোমতে উদ্ধার করিতে হইবে । লক্ষ্মী যখন ইচ্ছা করেন তখন এমনি করিয়াই কখনো সদর কখনো খিড়কি দরজা দিয়া অনাহূত আসিয়া উপস্থিত হন । আমি ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, “ব্যাপারটা বড়ো গুরুতর ” দুটাে-একটা কল্পিত উদাহরণ প্রয়োগ করিলাম, কম্পমান বৃদ্ধ হরিনাথ শিশুর মতে কঁাদিতে লাগিল । বিস্তারিত বলা বাহুল্য, কন্যার অস্ত্যেষ্টিসৎকারের সুযোগ করিতে হরিনাথ ফতুর হইয়া গেল । আমার কন্যা শশী করুণ স্বরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, ঐ বুড়ো তোমার পায়ে ধরিয়া কেন আমন করিয়া কাদিতেছিল ।” আমি তাহাকে ধমক দিয়া বলিলাম, “যা যা, তোর এত খবরে দরকার दी ।" এইবার সৎপাত্রে কন্যাদানের পথ সুপ্ৰশস্ত হইল। বিবাহের দিন স্থির হইয়া গেল । একমাত্র কন্যার বিবাহ, ভোজের আয়োজন প্রচুর করিলাম। বাডিতে গৃহিণী নাই, প্রতিবেশীরা দয়া করিয়া আমাকে সাহায্য করিতে আসিল । সর্বস্বাস্ত কৃতজ্ঞ হরিনাথ দিনরাত্রি খাটিতে লাগিল । গায়ে-হলুদের দিনে রাত তিনটার সময় হঠাৎ শশীকে ওলাউঠায় ধরিল । রোগ উত্তরোত্তর কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল । অনেক চেষ্টার পর নিম্বফল ঔষধের শিশিগুলা ভূতলে ফেলিয়া ছুটিয়া গিয়া হরিনাথের পা জড়াইয়া ধরিলাম । কহিলাম, “মাপ করো দাদা, এই পাষণ্ডকে মাপ করো। আমার একমাত্ৰ কন্যা, আমার আর কেহ নাই ।” হরিনাথ শশব্যস্ত হইয়া কহিল, “ডাক্তারবাবু, করেন কী, করেন কী । আপনার কাছে আমি চিরাত্মণী, আমার পায়ে হাত দিবেন না ।” আমি কহিলাম, “নিরপরাধে আমি তোমার সর্বনাশ করিয়াছি, সেই পাপে আমার কন্যা মরিতেছে।” এই বলিয়া সর্বলোকের সমক্ষে আমি চীৎকার করিয়া বলিলাম, “ওগো, আমি এই বুদ্ধের সর্বনাশ করিয়াছি, আমি তাহার দণ্ড লইতেছি, ভগবান আমার শশীকে রক্ষা করুন ।” বলিয়া হরিনাথের চটিজুতা খুলিয়া লইয়া নিজের মাথায় মারিতে লাগিলাম, বৃদ্ধ ব্যস্তসমস্ত হইয়া

  • দশটা-বেলায় গায়ে-হলুদের হরিদ্রাচিহ্ন লইয়া শশী ইহসংসার হইতে চিরবিদায় গ্রহণ