পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

te \Oهو তাহার পরদিনেই দারোগাবাবু কহিলেন, “ওহে। আর কেন, এইবার বিবাহ করিয়া ফেলো । দেখাশুনার তো একজন লোক চাই ?” মানুষের মর্মান্তিক দুঃখশোকের প্রতি এরূপ নিষ্ঠুর অশ্রদ্ধা শয়তানকেও শোভা পায় না। কিন্তু, নানা ঘটনায় দারোগার কাছে এমন মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়াছিলাম যে, কোনাে কথা বলিবার মুখ ছিল না। দারোগার বন্ধুত্ব সেই দিন যেন আমাকে চাবুক মারিয়া অপমান করিল। হৃদয় যতই ব্যথিত থাক, কর্মচক্ৰ চলিতেই থাকে। আগেকার মতোই ক্ষুধার আহার, পরিধানের বস্ত্র, এমন-কি, চুলার কাষ্ঠ এবং জুতার ফিতা পর্যন্ত পরিপূর্ণ উদ্যমে নিয়মিত সংগ্ৰহ করিয়া ফিরিতে হয় । কাজের অবকাশে যখন একলা ঘরে আসিয়া বসিয়া থাকি তখন মাঝে মাঝে কানে সেই করুণ কণ্ঠের প্রশ্ন বাজিতে থাকে, “বাবা, ঐ বুড়ো তোমার পায়ে ধরিয়া কেন অমন করিয়া কাদিতেছিল ।” দরিদ্র হরিনাথের জীৰ্ণ ঘর নিজের ব্যয়ে ছাইয়া দিলাম, আমার দুগ্ধবতী গাভীটি তাহাকে দান করিলাম, তাহার বন্ধকি জোতজমা মহাজনের হাত হইতে উদ্ধার করিয়া দিলাম । কিছুদিন সদ্যশোকের দুঃসহ বেদনায় নির্জন সন্ধ্যায় এবং অনিদ্র রাত্রে কেবলই মনে হইত, আমার কোমলহৃদয়া মেয়েটি সংসারলীলা শেষ করিয়াও তাহার বাপের নিষ্ঠুর দুষ্কর্মে পরলোকে কোনোমতেই শান্তি পাইতেছে না । সে যেন ব্যথিত হইয়া কেবলই আমাকে প্রশ্ন করিয়া ফিরিতেছে, বাবা, কেন এমন করিলে । কিছুদিন এমনি হইয়াছিল, গরিবের চিকিৎসা করিয়া টাকার জন্য তাগিদ করিতে পারিতাম না । কোনো ছোটাে মেয়ের ব্যামো হইলে মনে হইত। আমার শশীই যেন পল্লীর সমস্ত রুগণা বালিকার মধ্যে G315 C\515 <refRCVOCR | তখন পুরা বর্ষায় পল্লী ভাসিয়া গেছে। ধানের খেত এবং গৃহের অঙ্গনপাৰ্থ দিয়া নীেকায় করিয়া । ফিরিতে হয় । ভোররাত্রি হইতে বৃষ্টি শুরু হইয়াছে, এখনো বিরাম নাই। জমিদারের কাছারিবাড়ি হইতে আমার ডাক পড়িয়াছে। বাবুদের পান্সির মাঝি সামান্য বিলম্বটুকু সহ্য করিতে না পারিয়া উদ্ধত হইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছে । ইতিপূর্বে এরূপ দুর্যোগে যখন আমাকে বাহির হইতে হইত। তখন একটি লোক ছিল যে আমার পুরাতন ছাতাটি খুলিয়া দেখিত তাহাতে কোথাও ছিদ্র আছে কি না, এবং একটি ব্যগ্র কণ্ঠ বাদলার হাওয়া ও বৃষ্টির ছাট হইতে সযত্নে আত্মরক্ষা করিবার জন্য আমাকে বারংবার সতর্ক করিয়া দিত। আজ শূন্য নীরব গৃহ হইতে নিজের ছাতা নিজে সন্ধান করিয়া লইয়া বাহির হইবার সময় তাহার সেই স্নেহময় মুখখানি স্মরণ করিয়া একটুখানি বিলম্ব হইতেছিল। তাহার রুদ্ধ শয়নঘরটার দিকে তাকাইয়া ভাবিতেছিলাম, যে লোক পরের দুঃখকে কিছুই মনে করে না। তাহার সুখের জন্য ভগবান ঘরের মধ্যে এত মেহের আয়োজন কেন রাখিবেন । এই ভাবিতে ভাবিতে সেই শূন্য ঘরটার দরজার কাছে আসিয়া বুকের মধ্যে হু হু করিতে লাগিল । বাহিরে বড়োলোকের ভূত্যের তর্জনস্বর শুনিয়া তাড়াতাড়ি শোক সংবরণ করিয়া বাহির হইয়া পড়িলাম । নীেকায় উঠিবার সময় দেখি, থানার ঘাটে ডোঙা বাধা, একজন চাষা কীেপীন পরিয়া বৃষ্টিতে ভিজিতেছে । আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কী রে ” উত্তরে শুনিলাম গতরাত্রে তাহার কন্যাকে সাপে কাটিয়াছে, থানায় রিপোর্ট করিবার জন্য হতভাগ্য তাহাকে দূরগ্রাম হইতে বহিয়া আনিয়াছে। দেখিলাম, সে তাহার নিজের একমাত্র গাত্রবস্ত্ৰ খুলিয়া মৃতদেহ ঢাকিয়া রাখিয়াছে। জমিদারি কাছারির অসহিষ্ণু মাঝি নীেকা ছাড়িয়া দিল । বেলা একটার সময় বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখি, তখনো সেই লোকটা বুকের কাছে হাত পা গুটািইয়া বসিয়া বসিয়া ভিজিতেছে ; দারোগাবাবুর দর্শন মেলে নাই। আমি তাহাকে আমার রন্ধন-অয়ের এক অংশ পাঠাইয়া দিলাম। সে তাহা ইল না। তাড়াতাড়ি আহার সারিয়া কাছারির রোগীর তাগিদে পুনর্বার বাহির হইলাম। সন্ধ্যার সময় বাড়ি