পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sኣbr8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী শৌখিন অমলের শখ মিটাইয়া দেয়। অমল মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে, “বউঠান, কতদূর হইল।” চারুলতা মিথ্যা করিয়া বলে, “কিছুই হয় নি।” কখনো বলে, “সে আমার মনেই ছিল না ।” কিন্তু অমল ছাড়িবার পাত্র নয় । প্রতিদিন স্মরণ করাইয়া দেয় এবং আবদার করে । নাছোড়বান্দা অমলের সেই সকল উপদ্রব উদ্রেক করাইয়া দিবার জন্যই চারু ঔদাসীন্য প্রকাশ করিয়া বিরোধের সৃষ্টি করে এবং হঠাৎ একদিন তাহার প্রার্থনা পূরণ করিয়া দিয়া কৌতুক দেখে । ধনীর সংসারে চারুকে আর কাহারও জন্য কিছুই করিতে হয় না, কেবল অমল তাহাকে কাজ না করাইয়া ছাড়ে না। এ-সকল ছোটােখাটাে শখের খাটুনিতেই তাহার হৃদয়বৃত্তির চর্চা এবং চরিতার্থতা হইত । ভূপতির অন্তঃপুরে যে একখণ্ড জমি পড়িয়া ছিল তাহাকে বাগান বলিলে অনেকটা অত্যক্তি করা হয় । সেই বাগানের প্রধান বনস্পতি ছিল একটা বিলাতি আমড়া গাছ । এই ভূখণ্ডের উন্নতিসাধনের জন্য চারু এবং অমলের মধ্যে একটা কমিটি বসিয়াছে। উভয়ে মিলিয়া কিছুদিন হইতে ছবি আঁকিয়া, প্ল্যান করিয়া, মহা উৎসাহে এই জমিটার উপরে একটা বাগানের কল্পনা ফলাও করিয়া তুলিয়াছে। অমল বলিল, “বউঠান, আমাদের এই বাগানে সেকালের রাজকন্যার মতো তোমাকে নিজের হাতে গাছে জল দিতে হবে ।” চারু কহিল, “আর ঐ পশ্চিমের কোণটাতে একটা কুঁড়ে তৈরি করে নিতে হবে, হরিণের বাচ্ছা! থাকবে ।” অমল কহিল, “আর-একটি ছোটোখাটো বিলের মতো করতে হবে, তাতে ইয়াস চরিবে ।” চারু সে প্রস্তাবে উৎসাহিত হইয়া কহিল, “আর তাতে নীলপত্র দেব, আমার অনেকদিন থেকে নীলপদ্ম দেখবার সাধ আছে ।” অমল কহিল, “সেই বিলের উপর একটি সাকো বেঁধে দেওয়া যাবে, আর ঘাটে একটি বেশ ছোটো ডিঙি থাকবে ।” চারু কহিল, “ঘটি অবশ্য সাদা মার্কেলের হবে ।” অমল পেনসিল কাগজ লইয়া রুল কাটিয়া কম্পাস ধরিয়া মহা আড়ম্বরে বাগানের একটা ম্যাপ चैवाकिया । উভয়ে মিলিয়া দিনে দিনে কল্পনার সংশোধন পরিবর্তন করিতে করিতে বিশ-পঁচিশখন নূতন ম্যাপ আঁকা হইল । ম্যাপ খাড়া হইলে কত খরচ হইতে পারে তাহার একটা এসটিমেট তৈরি হইতে লাগিল। প্রথমে সংকল্প ছিল- চারু নিজের বরাদ্দ মাসহর হইতে ক্ৰমে ক্ৰমে বাগান তৈরি করিয়া তুলিবে ; ভূপতি তো বাড়িতে কোথায় কী হইতেছে তাহা চাহিয়া দেখে না ; বাগান তৈরি হইলে তাহকে সেখানে নিমন্ত্ৰণ করিয়া আশ্চৰ্য করিয়া দিবে ; সে মনে করিবে, আলাদিনের প্রদীপের সাহায্যে জাপান দেশ হইতে একটা আন্ত বাগান তুলিয়া আনা হইয়াছে। কিন্তু এসটিমেট যথেষ্ট কম করিয়া ধরিলেও চারুর সংগতিতে কুলায় না। অমল তখন পুনরায় ম্যাপি পরিবর্তন করিতে বসিল । কহিল, “তা হলে বউঠান, ঐ বিলটা বাদ দেওয়া যাক ৷” চারু কহিল, “না না, বিল বাদ দিলে কিছুতেই চলবে না, ওতে আমার নীলপত্র থাকবে ।” অমল কহিল, “তোমার হরিণের ঘরে টালির ছাদ নাই দিলে। ওটা আমনি একটা সাদাসিধে খোড়ো চাল করলেই হবে। ” চারু অত্যন্ত রাগ করিয়া কহিল, “তা হলে আমার ও ঘরে দরকার নেই- ও খাৰু।” মরিশািস হইতে লবঙ্গ, কর্নটি হইতে চন্দন, এবং সিংহল হইতে দারচিনির চারা আনাইবার প্রভাব ছিল, অমল তাহার পরিবর্তে মানিকতলা হইতে সাধারণ দিশি ও বিলাতি গাছের নাম করিতেই চারু মুখ ভায় করিয়া বসিল ; কহিল, “তা হলে আমার বাগানে কাজ নেই।”