পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܓ ܠ তাহাদের একটা দস্তুর ছিল ; আমল সেটা হঠাৎ কী বলিয়া ছাড়ে । অবশেষে মন্দাকিনী নিকটবর্তিনী হইলে অমল যেন বলপূর্বক সৌজন্য করিয়া বলিত, “তার পরে, মন্দা-বউঠান, আজ তোমার পানের বাটায় বাটপাড়ির লক্ষণ কিছু দেখলে ?” মন্দা । যখন চাইলেই পাও ভাই, তখন চুরি করবার দরকার ! অমল । চেয়ে পাওয়ার চেয়ে তাতে সুখ বেশি। মন্দা । তোমরা কী পড়ছিলে পড়ো-না, ভাই । থামলে কেন । পড়া শুনতে আমার বেশ লাগে । ইতিপূর্বে পাঠানুরাগের জন্য খ্যাতি অর্জন করিতে মন্দার কিছুমাত্র চেষ্টা দেখা যায় নাই, কিন্তু ‘কালোহি বলবত্তরঃ' } চারুর ইচ্ছা নহে অরসিকা মন্দার কাছে অমল পড়ে, অমলের ইচ্ছা মন্দাও তাহার লেখা শোনে । চারু । অমল কমলাকান্তের দপ্তরের সমালোচনা লিখে এনেছে, সে কি তোমারমন্দা। হলোমই বা মুখখু, তবু শুনলে কি একেবারেই বুঝতে পারি। নে । তখন আর-একদিনের কথা অমলের মনে পড়িল । চারুতে মন্দাতে বিন্তি খেলিতেছে, সে তাহার লেখা হাতে করিয়া খেলাসভায় প্রবেশ করিল । চারুকে শুনাইবার জন্য সে অধীর, খেলা ভাঙিতেছে না দেখিয়া সে বিরক্ত । অবশেষে বলিয়া উঠিল, “তোমরা তবে খেলো বউঠান, আমি অখিলবাবুকে লেখাটা শুনিয়ে আসি গে৷ ” চারু অমলের চাদর চাপিয়া কহিল, “আঃ, বোসো-না, যাও কোথায় ।” বলিয়া তাড়াতাডি হারিয়া খেলা শেষ করিয়া দিল । মন্দা বলিল, “তোমাদের পড়া আরম্ভ হবে বুঝি ? তবে আমি উঠি ।” চারু ভদ্রতা কবিয়া কহিল, “কেন, তুমিও শোনো-না ভাই ।” মন্দা । না ভাই, আমি তোমাদের ও-সব ছাইপাশ কিছুই বুঝি নে ; আমার কেবল ঘুম পায় । বলিয়া সে অকালে খেলাভঙ্গে উভয়ের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া চলিয়া গেল । সেই মন্দা আজ কমলাকান্তের সমালোচনা শুনিবার জন্য উৎসুক । অমল কহিল, “তা বেশ তো মন্দা-বউঠান, তুমি শুনবে সে তো আমার সৌভাগ্য ।” বলিয়া পাত উলটাইয়া আবার গোড়া হইতে পড়িবার উপক্রম করিল ; লেখার আরম্ভে সে অনেকটা পরিমাণ বাস ছড়াইয়াছিল, সেটুকু বাদ দিয়া পড়িতে তাহার প্রবৃত্তি হইল না । চারু তাড়াতাড়ি বলিল, “ঠাকুরপো, তুমি যে বলেছিলে জাহ্নবী লাইব্রেরি থেকে পুরোনো মাসিক পত্র কতকগুলো এনে দেবে ।” ve ( CS) elle R3 | চারু । আজই তো । বেশ । ভুলে গেছ বুঝি । অমল । ভুলব কেন । তুমি যে বলেছিলেচারু । আচ্ছা বেশ, এনে না । তোমরা পড়ে । আমি যাই, পরেশকে লাইব্রেরিতে পাঠিয়ে দিই গে। বলিয়া চারু উঠিয়া পড়িল । অমল বিপদ আশঙ্কা করিল। মন্দা মনে মনে বুঝিল এবং মুহুর্তের মধ্যেই চারুর প্রতি তাহার মন বিষাক্ত হইয়া উঠিল । চারু চলিয়া গেলে অমল যখন উঠিবে কি না ভাবিয়া ইতস্তত করিতেছিল মন্দা ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “যাও ভাই, মান ভাণ্ডাও গে ; চারু রাগ করেছে। আমাকে লেখা শোনালে মুশকিলে পড়বে।” ইহার পরে অমলের পক্ষে ওঠা অত্যন্ত কঠিন । অমল চারুর প্রতি কিছু রুট হইয়া কহিল, “কেন, মুশকিল কিসের ” বলিয়া লেখা বিস্তৃত করিয়া ধরিয়া পড়িবার উপক্ৰম করিল। মন্দা দুই হাতে তাহার লেখা আচ্ছাদন করিয়া বলিল, “কােজ নেই ভাই, পোড়ো না।” বলিয়া, যেন অশ্ৰষ্ঠ সংবরণ করিয়া, অন্যত্ৰ চলিয়া গেল ।