পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se 8 Od ভূপতি হাসিয়া কহিল, “কালো রূপ ভোলবার জন্যেই তাে সাত সমুদ্র পেরেনো। তা, ভয় কী চারু, আমরা রইলুম, কালোর ভক্তের অভাব হবে না।” ভূপতি খুশি হইয়া তখনই বর্ধমানে চিঠি লিখিয়া পাঠাইল। বিবাহের দিন স্থির হইয়া গেল । छ्वा *द्भि८छ् ইতিমধ্যে কাগজখানা তুলিয়া দিতে হইল। ভূপতি খরচ। আর জোগাইয়া উঠিতে পারিল না। লোকসাধারণ-নামক একটা বিপুল নির্মম পদার্থের যে সাধনায় ভূপতি দীর্ঘকাল দিনরাত্রি একান্ত মনে নিযুক্ত ছিল সেটা এক মুহুর্তে বিসর্জন দিতে হইল। ভূপতির জীবনে সমস্ত চেষ্টা যে অভ্যন্ত পথে গত বারো বৎসর অবিচ্ছেদে চলিয়া আসিতেছে সেটা হঠাৎ এক জায়গায় যেন জলের মাঝখানে আসিয়া পড়িল । ইহার জন্য ভূপতি কিছুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। অকস্মাৎ-বাধাপ্ৰাপ্ত তাহার এতদিনকার সমস্ত উদ্যমকে সে কোথায় ফিরাইয়া লইয়া যাইবে । তাহারা যেন উপবাসী অনাথ শিশু-সন্তানদের মতো ভূপতির মুখের দিকে চাহিল, ভূপতি তাহাদিগকে আপন অন্তঃপুরে করুণাময়ী শুশ্ৰষাপরায়ণা নারীর কাছে আনিয়া দাড় করাইল । নারী তখন কী ভাবিতেছিল । সে মনে মনে বলিতেছিল 'এ কী আশ্চৰ্য, অমলের বিবাহ হইবে সে তো খুব ভালোই । কিন্তু এতকাল পরে আমাদের ছাডিয়া পরের ঘরে বিবাহ করিয়া বিলাত চলিয়া যাইবে, ইহাতে তাহার মনে একবারও একটুখানির জন্য দ্বিধাও জন্মিল না ? এতদিন ধরিয়া তাহাকে যে আমরা এত যত্ন করিয়া রাখিলাম, আর যেমনি বিদায় লইবার একটুখানি ফাক পাইল অমনি কোমর ধাধিয়া প্ৰস্তুত হইল, যেন এতদিন সুযোগের অপেক্ষা করিতেছিল। অথচ মুখে কতই মিষ্ট, কতই ভালোবাসা । মানুষকে চিনিবার জো নাই । কে জানিত, যে লোক এত লিখিতে পারে তাহার হৃদয় কিছুমাত্র নাই ।” নিজের হৃদয়প্রাচুর্যের সহিত তুলনা করিয়া চারু অমলের শূন্য হৃদয়কে অত্যন্ত অবজ্ঞা করিতে অনেক চেষ্টা করিল। কিন্তু পারিল না । ভিতরে ভিতরে নিয়ত একটা বেদনার উদবেগ তপ্ত শূলের মতো তাহার অভিমানকে ঠেলিয়া ঠেলিয়া তুলিতে লাগিল- ‘অমল আজ বাদে কাল চলিয়া যাইবে, তবু এ কয়দিন তাহার দেখা নাই । আমাদের মধ্যে যে পরস্পর একটা মনান্তর হইয়াছে সেটা মিটাইয়া লইবার আর অবসরও হইল না চারু প্রতিক্ষণে মনে করে অমল আপনি আসিবে- তাহদের এতদিনকার খেলাধুলা এমন করিয়া ভাঙিবে না, কিন্তু অমল আর আসেই না । অবশেষে যখন যাত্রার দিন অত্যন্ত নিকটবতী হইয়া আসিল তখন চারু নিজেই অমলকে ডাকিয়া পাঠাইল । অমল বলিল, “আর একটু পরে যাচ্ছি।” চারু তাহদের সেই বারান্দার চৌকিটাতে গিয়া বসিল । সকালবেলা হইতে ঘন মেঘ করিয়া শুমাির্ট হইয়া আছে- চারু তাহার খোলা চুল এলো করিয়া মাথায় জড়াইয়া একটা হাতপাখা লইয়া ক্লান্ত দেহে অল্প অল্প বাতাস করিতে লাগিল । অত্যন্ত দেরি হইল । ক্রমে তাহার হাতপাখা আর চলিল না। রাগ দুঃখ অধৈর্য তাহার বুকের ভিতরে ফুটিয়া উঠিল । মনে মনে বলিল- নাই আসিল অমল, তাতেই বা কী । কিন্তু তবু পদশব্দ মাত্রেই তাহার মন দ্বারের দিকে চুটিয়া যাইতে লাগিল । , দূর গির্জায় এগারোটা বাজিয়া গেল । স্নানান্তে এখনই ভূপতি খাইতে আসিবে। এখনো আধা ঘণ্টা সময় আছে, এখনো অমল যদি আসে। যেমন করিয়া হােক, তাহদের কয়দিনকার নীরব ঝগড়া আজ মিটাইয়া ফেলিতেই হইবে- অমলকে এমনভাবে বিদায় দেওয়া যাইতে পারে না । এই সমবয়সি দেওর-ভাজের মধ্যে যে চিরন্তন মধুর সম্বন্ধটুিকু আছে- অনেক ভাব, আড়ি, অনেক জেহের দীেরাত্ম্য, অনেক বিশ্রান্ধ সুখালোচনায় বিজড়িত একটি চিরাচ্ছায়াময় লতাবিতান- অমল সে কি আজ ধুলায় লুটাইয়া দিয়া বহুদিনের জন্য বহুদূরে চলিয়া যাইবে । একটু পরিতাপ হইবে না ? তাহার তলে কি শেষ জলও সিঞ্চন করিয়া যাইবে না- তাহদের অনেকদিনের দেওর-ভাজ সম্বন্ধের শেষ অশ্রািজল !