পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

kov 8 SS ভূপতি কোথায় অমলের স্মৃতির আক্রমণ হইতে তাহাকে রক্ষা করিবে, তাহা না করিয়া সেই বিচ্ছেদব্যথিত স্নেহশীল মূঢ় কেবলই অমলের কথাই মনে করাইয়া দেয়। অবশেষে চারু একেবারে হাল ছাড়িয়া দিল- নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করায় ক্ষান্ত হইল ; হার মানিয়া নিজের অবস্থাকে অবিরোধে গ্রহণ করিল। অমলের স্মৃতিকে যত্নপূর্বক হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়া লাইল । ক্রমে এমনি হইয়া উঠিল, একাগ্ৰচিত্তে অমলের ধ্যান তাহার গোপন গর্বের বিষয় হইল- সেই স্মৃতিই যেন তাহার জীবনের শ্ৰেষ্ঠ গীেরব। গৃহকার্যের অবকাশে একটা সময় সে নির্দিষ্ট করিয়া লইল । সেই সময় নির্জনে গৃহদ্বার রুদ্ধ করিয়া তন্ন তন্ন করিয়া অমলের সহিত তাহার নিজ জীবনের প্রত্যেক ঘটনা চিন্তা করিত । উপুড় হইয়া বালিশের উপর মুখ রাখিয়া বার বার করিয়া বলিত, “অমল, অমল, অমল ?” সমুদ্র পার হইয়া যেন শব্দ আসিত, “বোঠান, কী বোঠান ।” চারু সিক্ত চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বলিত, “অমল, তুমি রাগ করিয়া চলিয়া গেলে কেন । আমি তো কোনো দোষ করি নাই । তুমি যদি ভালোমুখে বিদায় লইয়া যাইতে, তাহা হইলে বোধ হয়। আমি এত দুঃখ পাইতাম না ।” অমল সম্মুখে থাকিলে যেমন কথা হইত চারু ঠিক তেমনি করিয়া কথাগুলি উচ্চারণ করিয়া বলিত, “আমল, তোমাকে আমি একদিনও ভুলি নাই । একদিনও না, একদণ্ডও না । আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পদার্থ সমন্ত তুমিই ফুটাইয়াছ আমার জীবনের সারভাগ দিয়া প্রতিদিন তোমার পূজা করিব।” এইরূপে চারু তাহার সমস্ত ঘরকন্না তাহার সমস্ত কতর্ব্যের অন্তঃস্তরের তলদেশে সুড়ঙ্গ খনন করিয়া সেই নিরালোক নিন্তৱন্ধ অন্ধকারের মধ্যে অশ্রুমালাসাজিত একটি গোপন শোকের মন্দির নির্মাণ করিয়া রাখিল । সেখানে তাহার স্বামী বা পৃথিবীর আর-কাহারও কোনো অধিকার রহিল না । সেই স্থানটুকু যেমন গোপনতম, তেমনি গভীরতম, তেমনি প্ৰিয়তম । তাহারই দ্বারে সে সংসারের সমস্ত ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া নিজের অনাবৃত আত্মস্বরূপে প্ৰবেশ করে এবং সেখান হইতে বাহির হইয়া মুখোশখানা আবার মুখে দিয়া পৃথিবীর হাস্যালাপ ও ক্রিয়াকর্মের রঙ্গভূমির মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হয় । ষোড়শ পরিচ্ছেদ এইরূপে মনের সহিত দ্বন্ত্ববিবাদ ত্যাগ করিয়া চারু তাহার বৃহৎ বিষাদের মধ্যে একপ্রকার শান্তিলাভ করিল এবং একনিষ্ঠ হইয়া স্বামীকে ভক্তি ও যত্ন করিতে লাগিল। ভূপতি যখন নিদ্রিত থাকিত চারু তখন ধীরে ধীরে তাহার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া পায়ের ধুলা সীমান্তে তুলিয়া লইত । সেবাশুশ্ৰষায় গৃহকর্মে স্বামীর লেশমাত্র ইচ্ছা সে অসম্পূর্ণ রাখিত না । আশ্রিত প্ৰতিপালিত ব্যক্তিদের প্রতি কোনোপ্রকার অযত্নে ভূপতি দুঃখিত হইত জানিয়া, চারু তাহদের প্রতি আতিথ্যে তিলমাত্র ক্রটি ঘটিতে দিত না । এইরূপে সমন্ত কাজকর্ম সারিয়া ভূপতির উচ্ছিষ্ট প্রসাদ খাইয়া চারুর দিন শেষ হইয়া যাইত । এই সেবা ও যত্নে ও ভগ্নশ্ৰী ভূপতি যেন নবযৌবন ফিরিয়া পাইল। মীর সহিত পূর্বে যেন তাহার নববিবাহ হয় নাই, এতদিন পরে যেন হইল । সাজসজায় হস্যে পরিহাসে বিকশিত হইয়া সংসারের সমন্ত দুর্ভাবনাকে ভূপতি মনের একপাশে ঠেলিয়া রাখিয়া দিল । রোগ-আরামের পর যেমন ক্ষুধা বাড়িয়া উঠে, শরীরে ভোগশক্তির বিকাশকে সচেতনভাবে অনুভব করা যায়, ভূপতির মনে এতকাল পরে সেইরূপ একটা অপূর্ব এবং প্রবল ভাবাবেশের সঙ্কার হইল। বন্ধু দিগকে, এমন-কি, চারুকে লুকাইয়া ভূপতি কেবল কবিতা পড়িতে লাগিল। মনে মনে কহিল, "কাগজখানা গিয়া এবং অনেক দুঃখ পাইয়া এতদিন পরে আমি আমার বীকে আবিষ্কার করিতে পারিয়াহি ।” ভূপতি চারুকে বলিল, “চারু, তুমি আজকাল লেখা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছ। কেন ।” ծ Տ | | Հ Գ