পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

five SS O চারু অমলের একখানা চিঠিও পাইল না। ভূপতির চিঠিগুলি চাহিয়া লইয়া উলটিয়া পালটিয়া বার বার করিয়া পড়িয়া দেখিল- প্ৰণামজ্ঞাপন ছাড়া আর কোথাও তাহার সম্বন্ধে আভাসমােত্রও নাই । চারু এই কয়দিন যে একটি শান্ত বিবাদের চন্দ্ৰাতপািচ্ছায়ার আশ্ৰয় লইয়াছিল অমলের এই উপেক্ষায় তাহা ছিন্ন হইয়া গেল । অন্তরের মধ্যে তাহার হৃৎপিণ্ডটা লইয়া আবার যেন ছেড়াটুেড়ি আরম্ভ হইল । তাহার সংসারের কর্তব্যস্থিতির মধ্যে আবার ভূমিকম্পের আন্দোলন জাগিয়া উঠিল । এখন ভূপতি এক-একদিন অর্ধরাত্রে উঠিয়া দেখে, চারু বিছানায় নাই। খুঁজিয়া খুজিয়া দেখে, চারু দক্ষিণের ঘরের জানালায় বসিয়া আছে । তাহাকে দেখিয়া চারু তাড়াতাড়ি উঠিয়া বলে, “ঘরে আজ যে গরম, তাই একটু বাতাসে এসেছি।” ভূপতি উদবিগ্ন হইয়া বিছানায় পাখা টানার বন্দোবন্ত করিয়া দিল, এবং চারুর স্বাস্থ্যভঙ্গ আশঙ্কা করিয়া সর্বদাই তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিল । চারু, হাসিয়া বলিত, “আমি বেশ আছি, তুমি কেন মিছামিছি ব্যস্ত হও ।” এই হাসিটুকু ফুটাইয়া তুলিতে তাহার বক্ষের সমন্ত শক্তি প্রয়োগ করিতে হইত । অমল বিলাতে পৌঁছিল। চারু স্থির করিয়াছিল, পথে তাহাকে স্বতন্ত্ৰ চিঠি লিখিবার যথেষ্ট সুযোগ হয়তো ছিল না, বিলাতে পৌঁছিয়া অমল লম্বা চিঠি লিখিবে । কিন্তু সে লম্বা চিঠি আসিল না । প্ৰত্যেক মেল আসিবার দিনে চারু তাহার সমস্ত কাজকর্ম কথাবার্তার মধ্যে ভিতরে ভিতরে ছটফট করিতে থাকিত । পাছে ভূপতি বলে, “তোমার নামে চিঠি নাই এইজন্য সাহস করিয়া ভূপতিকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে পারিত না । এমন অবস্থায় একদিন চিঠি আসিবার দিনে ভূপতি মন্দগমনে আসিয়া মৃদুহাস্যে কহিল, “একটা জিনিস আছে, দেখবে ?” চারু ব্যান্তসমান্ত চমকিত হইয়া কহিল, “কই দেখাও ।” ভূপতি পরিহাসপূর্বক দেখাইতে চাহিল না। চারু অধীর হইয়া ভূপতির চাদরের মধ্য হইতে বাঞ্ছিত পদার্থ কড়িয়া লইবার চেষ্টা করিল। সে মনে মনে ভাবিলে, “সকাল হইতেই আমার মন বলিতেছে, আজ আমার চিঠি আসিবেই- এ কখনো বার্থ হইতে পারে না ।" ভূপতির পরিহাসম্পহা ক্রমেই বাডিয়া উঠিল ; সে চারুকে এড়াইয়া খাটের চারি দিকে ফিরিতে লাগিল । তখন চারু একান্ত বিরক্তির সহিত খাটের উপর বসিয়া চোখ ছলছল করিয়া তুলিল । চারুর একান্ত আগ্রহে ভূপতি অত্যন্ত খুশি হইয়া চাদরের ভিতর হইতে নিজের রচনার খাতাখানা বাহির করিয়া তাড়াতাড়ি চারুর কোলে দিয়া কহিল, “রাগ কোরো না । এই নাও ।” অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ অমল যদিও ভূপতিকে জানাইয়াছিল যে, পড়াশুনার তাড়ায় সে দীর্ঘকাল পত্র লিখিতে সময় না, আৰু দুই এক মেল তাহার পত্র না। আসতে সমন্ত সংসার চারুর পক্ষে কণ্টকশয্যা হইয়া সন্ধ্যাবেলায় পাচ কথার মধ্যে চারু অত্যন্ত উদাসীনভাবে শান্তস্বরে তাহার স্বামীকে কহিল, “আচ্ছা! দেখো, বিলেতে একটা টেলিগ্ৰাফ করে জানলে হয় না, অমল কেমন আছে ?” ভূপতি কহিল, “দুই হস্তা আগে তার চিঠি পাওয়া গেছে, সে এখন পড়ায় ব্যন্ত ।” চারু । ওঃ, তবে কাজ নেই । আমি ভাবছিলুম, বিদেশে আছে, যদি ব্যামোস্যামো হয়- বলা তো न् | ভূপতি । নাঃ, তেমন কোনো ব্যামো হলে খবর পাওয়া যেত। টেলিগ্ৰাফ করাও তো কম খরচা নয় ।