পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 S ( চারুর যে-সকল কথায় আদরে ব্যবহারে ভূপতি ভুলিয়াছিল সেগুলা মনে আসিয়া তাহাকে ‘মূঢ় মূঢ় মুঢ় বলিয়া বেত মারিতে লাগিল । অবশেষে তাহার বহু কষ্টের বহু যত্নের রচনাগুলির কথা যখন মনে উদয় হইল। তখন ভূপতি ধরণীকে দ্বিধা হইতে বলিল। অঙ্কুশতাড়িতের মতো চারুর কাছে দ্রুতপদে গিয়া ভূপতি কহিল, “আমার সেই লেখাগুলো কোথায় ।” চারু কহিল, “আমার কাছেই আছে।” ভূপতি কহিল, “সেগুলো দাও।” চারু তখন ভূপতির জন্য ডিমের কচুরি ভাজিতেছিল, কহিল, “তোমার কি এখনই চাই ।” ভূপতি কহিল, “হা, এখনই চাই ।” চারু কড়া নামাইয়া রাখিয়া আলমারি হইতে খাতা ও কাগজগুলি বাহির করিয়া আনিল । ভূপতি অধীরভাবে তাহার হাত হইতে সমস্ত টানিয়া লইয়া খাতপত্র একেবারে উনানের মধ্যে ফেলিয়া দিল । চারু ব্যন্ত হইয়া সেগুলা বাহির করিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “এ কী করলে ।” ভূপতি তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া গর্জন করিয়া বলিল, “থাক ।” চারু বিস্মিত হইয়া দাড়াইয়া রহিল । সমস্ত লেখা নিঃশেষে পুড়িয়া ভস্ম হইয়া গেল । চারু বুঝিল । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । কচুরিভাজা অসমাপ্ত রাখিয়া ধীরে ধীরে অন্যত্ৰ চলিয়া গেল । চারুর সম্মুখে খাতা নষ্ট করিবার সংকল্প ভূপতির ছিল না। কিন্তু ঠিক সামনেই আগুনটা জ্বলিতেছিল, দেখিয়া কেমন যেন তাহার খুন চাপিয়া উঠিল। ভূপতি আত্মসংবরণ করিতে না পারিয়া প্ৰবঞ্চিত নির্বোধের সমন্ত চেষ্টা বঞ্চনাকারিণীর সম্মুখেই আগুনে ফেলিয়া দিল । সমস্ত ছাই হইয়া গেল, ভূপতির আকস্মিক উচ্চামতা যখন শান্ত হইয়া আসিল তখন চারু আপন অপরাধের বোঝা বহন করিয়া যেরূপ গভীর বিষাদে নীরব নতমুখে চলিয়া গেল তাহা ভূপতির মনে জাগিয়া উঠিল— সম্মুখে চাহিয়া দেখিল, ভূপতি বিশেষ করিয়া ভালোবাসে বলিয়াই চারু স্বহন্তে যত্ন করিয়া খাবার তৈরি করিতেছিল । ভূপতি বারান্দার রেলিঙের উপর ভর দিয়া দাড়াইল । মনে মনে ভাবিতে লাগিল- তাহার জন্য চারুর এই যে-সকল অশ্রান্ত চেষ্টা, এই যে-সামন্ত প্ৰাণপণ বঞ্চনা ইহা অপেক্ষা সকরুণ ব্যাপার জগৎসংসারে আর কী আছে । এই--সামন্ত বঞ্চনা, এ তো ছলনাকারিণীর হেয় ছলনামাত্র নহে ; এই ছালনাগুলির জন্য ক্ষতহদায়ের ক্ষতযন্ত্রণা চতুৰ্ভণি বাড়াইয়া অভাগিনীকে প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে হৃৎপিণ্ড হইতে রক্ত নিষ্পেষণ করিয়া বাহির করিতে হইয়াছে। ভূপতি মনে মনে কহিল, ‘হায় অবলা, হায় দুঃখিনী । দরকার ছিল না, আমার এ-সব কিছুই দরকার ছিল না। এতকাল আমি তো ভালোবাসা না পাইয়াও “পাই নাই বলিয়া জানিতেও পারি নাই— আমার তো কেবল পুফ দেখিয়া, কাগজ লিখিয়াই চলিয়া গিয়াছিল ; আমার জন্য এত করিবার কোনো দরকার ছিল না ।” তখন আপনার জীবনকে চারুর জীবন হইতে দূরে সরাইয়া লইয়া— ডাক্তার যেমন সাংঘাতিক ব্যাধিগ্রন্ত রোগীকে দেখে, ভূপতি তেমনি করিয়া নিঃসম্পর্ক লোকের মতো চারুকে দূর হইতে দেখিল ! ঐ একটি স্ট্রীণশক্তি নারীর হৃদয় কী প্ৰবল সংসারের দ্বারা চারি দিকে আক্রান্ত হইয়াছে। এমন লোক নাই যাহার কাছে সকল কথা ব্যক্ত করিতে পারে, এমন কথা নহে যাহা ব্যক্ত করা যায়, এমন স্থান নাই যেখানে সমস্ত হৃদয় উদঘাটিত করিয়া দিয়া সে হাহাকার করিয়া উঠিতে পারে- অথচ এই অপ্রকাশ্য অপরিহার্য অপ্রতিবিধেয় প্রত্যহপূঞ্জীভূত দুঃখভার বহন করিয়া নিতান্ত সহজ লোকের মতো, তাহার সুস্থচিত্ত প্রতিবেশিনীদের মতো, তাহাকে প্রতিদিনের গৃহকর্ম সম্পন্ন করিতে হইতেছে । ভূপতি তাহার শয়নগৃহে গিয়া দেখিল— জানালার গারাদে ধরিয়া অশ্রুহীন অনিমেষদৃষ্টিতে চারু বাহিরের দিকে চাহিয়া আছে। ভূপতি আন্তে আন্তে তাহার কাছে আসিয়া দাড়াইল- কিছু বলিল না, তাহার মাথার উপরে হাত রাখিল ।