পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 S by রবীন্দ্র-রচনাবলী স্ত্রীর বিদা দেখিয়া সৎস্বামীর যতটুকু গৰ্ব্ব ও আনন্দ হওয়া উচিত তাহা আমার হয় নাই এমন কথা বলিলে আমাকে অন্যায় অপবাদ দেওয়া হইবে, কিন্তু তারই সঙ্গে একটু অন্য ভাবও ছিল । সে ভাবটুকু উচ্চাদরেব না হইতে পারে, কিন্তু স্বাভাবিক । মুশকিল। এই যে, যে উপায়ে আমার বিদ্যার পরিচয় দিতে পারিতাম সেটা বালিকার পক্ষে দুৰ্গম । সে যেটুকু ইংরেজি জানে তাহাতে বার্ক-মেকলের ছাদের চিঠি তাহার উপরে চালাইতে হইলে মশা মারিতে কামান দাগ হইত— মশার কিছুই হইত না, কেবল ধোয় এবং আওয়াজই সারা হইত । আমার যে তিনটি প্রাণের বন্ধু ছিল তাহাদিগকে আমার স্ত্রীর চিঠি না দেখাইয়া থাকিতে পারিলাম না ; তাহারা আশ্চর্য হইয়া কহিল, “এমন স্ত্রী পাইয়াছ, ইহা তোমার ভাগা ।” অর্থাৎ ভাষান্তরে বলিতে গেলে এমন স্ত্রীর উপযুক্ত স্বামী আমি নই ৷ নিঝরিণীর নিকট হইতে পত্ৰোত্তর পাইবার পূর্বেই যে কখানি চিঠি লিখিয়া ফেলিয়ছিলাম তাহাতে হৃদয়োঙ্গাস যথেষ্ট ছিল, কিন্তু বানান-ভুলও নিতান্ত অল্প ছিল না । সতর্ক হইয়া লেখা যে দরকার তাহা তখন মনেও করি নাই | সতর্ক হইয়া লিখিলে বানান-ভুল হয়তো কিছু কম পড়িত, কিন্তু হৃদযোেচ্ছাসটাও মারা যাইত । এমন অবস্থায় চিঠির মধ্যস্থত ছাডিয়া মোকাবিলায় প্রেমালাপই নিরাপদ । সুতরাং, বাবা আপিসে গেলেই আমাকে কালেজ পালাইতে হইত । ইহাতে আমাদের উভয় পক্ষেরই পাঠ্যচর্চায় যে ক্ষতি হইত, আলাপচর্চায় তাহ সুন্দসুদ্ধ পোষণ করিয়া লইতাম । বিশ্বজগতে যে কিছুই একেবারে নষ্ট হয় না, এক আকারে যাহা ক্ষতি অন্য আকারে তাহা লাভ- বিজ্ঞানের এই তথ্য প্রেমের পরীক্ষাশালায় বারংবার যাচাই করিয়া লইয়া একেবারে নিঃসংশয় হইয়াছি । এমন সময়ে আমার স্ত্রীর জাঠতুতো বোনের বিবাহকাল উপস্থিত- আমরা তো যথানিয়মে আইবুডোভাত দিয়া খালাস, কিন্তু আমার স্ত্রী স্নেহের আবেগে এক কবিতা রচনা করিয়া লাল কাগজে লাল কালি দিয়া লিখিয়া তাহার ভুগিনীকে না পাঠাইয়া থাকিতে পারিল না। সেই রচনাটি কেমন করিয়া বাবাব হস্তগত হইল । বাবা তাহার বধুমাতার কবিতায় রচনানৈপূণ্য, সম্ভাবসৌন্দর্য, প্রসাদগুণ, প্রাঞ্জলতা ইত্যাদি শাস্ত্রসম্মত নানা গুণের সমাবেশ দেখিয়া অভিভূত হইয়া গেলেন । তাহার বৃদ্ধ বন্ধু দিগকে দেখাইলেন, তাহারাও তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, “খাসা হইয়াছে !” নববধূর যে রচনাশক্তি আছে। এ কথা কাহারও অগোচর রহিল না । হঠাৎ এইরূপ খ্যাতিবিকাশে রচয়িত্রীর কৰ্ণমূল এবং কপোলদ্বয় অরুণবৰ্ণ হইয়া উঠিয়ছিল ; অভ্যাসক্রমে তাহা বিলুপ্ত হইল। পূর্বেই বলিয়াছি, কোনো জিনিস। একেবারে বিলুপ্ত হয় না- কী জানি, লাজার আভাটুকু তাহার কোমল কপোল ছাড়িয়া আমার কঠিন হৃদয়ের প্রচ্ছন্ন কোণে হয়তো আশ্রয় লইয়া থাকিবে । কিন্তু তাই বলিয়া স্বামীর কর্তব্যে শৈথিল করি নাই । অপক্ষপাত সমালোচনার দ্বারা স্ত্রীর রচনার দোষ সংশোধনে আমি কখনোই আলস্যা করি নাই । বাবা তাহাকে নির্বিচারে যতই উৎসাহ দিয়াছেন, আমি ততই সতর্কতার সহিত ক্রটি নির্দেশ করিয়া তাহাকে যথোচিত সংযত করিয়াছি । আমি ইংরেজি বড়ো বড়ো লেখকের লেখা দেখাইয়া তাহাকে অভিভূত করিতে ছাড়ি নাই । সে কোকিলের উপর একটা কী লিখিয়াছিল, আমি শেলির স্কাইলার্ক ও কীটসের নাইটিঙ্গেল শুনাইয়া তাহাকে একপ্রকার নীরব করিয়া দিয়াছিলাম। তখন বিদ্যার জোরে আমিও যেন শেলি ও কীটসের গীেরবের কতকটা ভাগী হইয়া পড়িতাম । আমার স্ত্রীও ইংরেজি সাহিত্য হইতে ভালো ভালো জিনিস তাহকে তর্জমা করিয়া শুনাইবার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করিত, আমি গর্বের সহিত তাহার অনুরোধ রক্ষা করিতাম । তখন ইংরেজি সাহিত্যের মহিমায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়া আমার স্ত্রীর প্রতিভাকে কি স্নান করি নাই। স্ত্রীলোকের কমনীয়তার পক্ষে এই একটু ছায়ার আচ্ছাদন দরকার, বাবা এবং বন্ধুবান্ধবেরা তাহা বুঝিতেন না- কাজেই আমাকে এই কঠোর কর্তব্যের ভার লাইতে হইয়াছিল । নিশীথের চন্দ্ৰ মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো হইয়া উঠিলে দুই দণ্ড বাহবা দেওয়া চলে, কিন্তু তাহার পরে ভাবিতে হয়, ওটাকে ঢাকা দেওয়া যায় কী উপায়ে ।