পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓivgq}ዟ 8S আমার স্ত্রীর লেখা বাবা এবং অন্যান্য অনেকে কাগজে ছাপাইতে উদ্যত হইয়াছিলেন । নিকারিণী তাহাতে লজ্জাপ্রকাশ করিতে- আমি তাহার সে লিজা রক্ষা করিয়াছি। কাগজে ছাপিতে দিই নাই, কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রচার বন্ধ করিতে পারা গেল না। ইহার কুফল যে কতদূর হইতে পারে, কিছুকাল পরে তাহার পরিচয় পাইয়াছিলাম। তখন উকিল হইয়া আলিপুরে বাহির হই । একটা উইল-কেস লইয়া বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে খুব জোরের সহিত লড়িতেছিলাম। উইলটি বাংলায় লেখা । স্বপক্ষের অনুকূলে তাহার অর্থ যে কিরূপ স্পষ্ট তাহা বিধিমতে প্ৰমাণ করিতেছিলাম, এমন সময় বিরোধী পক্ষের উকিল উঠিয়া বলিলেন, “আমার বিজ্ঞান বন্ধু যদি তাহার বিদূষী স্ত্রীর কাছে এই উইলটি বুঝিয়া লইয়া আসিতেন, তবে এমন অদ্ভুত ব্যাখ্যা দ্বারা মাতৃভাষাকে ব্যথিত করিয়া তুলিতেন না।” চুলায় আগুন ধরাইবার বেলা যুঁ দিতে নাকের জলে চােখের জলে হইতে হয়, কিন্তু গৃহদাহের আগুন নেবানোই দায় । লোকের ভালো কথা চাপা থাকে, আর অনিষ্টকর কথাগুলো মুখে মুখে হুহুঃ শব্দে ব্যাপ্ত হইয়া যায় । এ গল্পটিও সর্বত্র প্রচারিত হইল । ভয় হইয়াছিল, পাছে আমার স্ত্রীর কানে ওঠে । সৌভাগ্যক্রমে ওঠে নাই- অন্তত এ সম্বন্ধে তাহার কাছ হইতে কোনো আলোচনা কখনো শুনি ! একদিন একটি অপরিচিত ভদ্রলোকের সহিত আমার পরিচয় হইতেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ আপনিই কি শ্ৰীমতী নিবরিণী দেবীর স্বামী ।” আমি কহিলাম, “আমি তাহার স্বামী কি না সে কথার জবাব দিতে চাহি না, তবে তিনিই আমার স্ত্রী বটেন ৷” বাহিরের লোকের কাছে স্ত্রীর স্বামী বলিয়া খাতিলাভ করা আমি গৌরবের বিষয় বলিয়া জ্ঞান করি না । সেটা যে গৌরবের বিষয় নহে, সে কথা আমাকে আর-এক ব্যক্তি অনাবশ্যক স্পষ্ট ভাষায় স্মরণ কাবাইয়া দিয়াছিল । পূর্বেই পাঠকগণ সংবাদ পাইয়াছেন, আমার স্ত্রীর জাঠতুতো বোনের বিবাহ হইয়াছে । তাহার স্বামীটা অত্যন্ত বর্বর দুৰ্বত্ত | স্ত্রীর প্রতি তাহার অত্যাচার অসহ্য । আমি এই পাষণ্ডের নির্দয়াচরণ লইয়া আত্মীযসমাজে আলোচনা করিয়াছিলাম, সে কথা অনেক বড়ো হইয়া তাহার কানে উঠিয়াছিল । সে তাহার পর হইতে আমার প্রতি লক্ষ করিয়া সকলের কাছে বলিয়া বেড়াইতেছে যে, নিজের নামে হইতে আরম্ভ করিয়া দৃশ্বশুরের নামে পর্যন্ত উত্তম-মধ্যম-অধম অনেকরকম খ্যাতির বিবরণ শাস্ত্ৰে লিখিয়াছে, কিন্তু নিজের স্ত্রীর খাতিতে যশস্বী হওয়ার কল্পনা কবির মাথাতেও আসে নাই । এমন-সব কথা লোকের মুখে মুখে চলিতে আরম্ভ করিলে স্ত্রীর মনে তো দন্তু জন্মিতেই পারে । বিশেষত বাবার একটা বদ অভ্যাস ছিল, নিঝরিণীর সামনেই তিনি আমাদের পরম্পরের বাংলাভাষাজ্ঞান লইয়া কৌতুক করিতেন । একদিন তিনি বলিলেন, “হরিশ যে বাংলা চিঠিগুলো লেখে তাহার বানানটা তুমি দেখিয়া দাও-না কেন, বউমা— আমাকে এক চিঠি লিখিয়াছে, তাহাতে সে 'জগদিন্দ্ৰ' লিখিতে দীর্ঘ ঈ বসাইয়াছে।” শুনিয়া বাবার বউমা নীরবে একটুখানি স্মিতহাস্য করিলেন । আমিও কথাটাকে ঠাটা বলিয়া হাসিলাম, কিন্তু এরকম ঠাটা ভালো নয় । স্ত্রীর দম্ভের পরিচয় পাইতে আমার দেরি হইল না। পাড়ার ছেলেদের এক ক্লাব আছে ; সেখানে একদিন তাহারা এক বিখ্যাত বাংলা-লেখককে বক্তৃতা দিতে রাজি করিয়াছিল । অপর একটি বিখ্যাত লোককে সভাপতিও ঠিক করা হয় ; তিনি বক্তৃতার পূর্বরাত্রে অস্বাস্থ্য জানাইয়া চুটি লাইলেন । ছেলেরা উপায়ান্তর না দেখিয়া আমাকে আসিয়া ধরিল । আমার প্রতি ছেলেদের এই অহৈতুকী শ্রদ্ধা দেখিয়া আমি কিছু প্ৰফুল্প হইয়া উঠিলাম ; বলিলাম, “তা বেশ তো, বিষয়টা কী বলে তো ?” তাহারা কহিল, “প্রাচীন ও আধুনিক বঙ্গসাহিত্য ।” আমি কহিলাম, “ বেশ হইবে, দুটােই আমি ঠিক সমান জানি।” পরদিন সভায় যাইবার পূর্বে জলখাবার এবং কাপড়াচোপড়ের জন্য স্ত্রীকে কিছু তাড়া দিতে লাগিলাম । নিঝরিণী কহিল, “কোন গো, এত ব্যন্ত কেন- আবার কি পাস্ত্রী দেখিতে যাইতেছে ।” আমি কহিলাম, “একবার দেখিয়াই নাকে-কানে খত দিয়াছি ; আর নয় ।”