পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8S O রবীন্দ্র-রচনাবলী “তবে এত সাজসজ্জার তাড়া যে ।” স্ত্রীকে সগর্বে সমস্ত ব্যাপারটা বলিলাম। শুনিয়া সে কিছুমাত্র উল্লাস প্রকাশ না করিয়া ব্যাকুলভাবে আমার হাত চাপিয়া ধরিল । কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ ? না, না, সেখানে তুমি যাইতে পরিবে না ।” আমি কহিলাম, “রাজপুতনারী যুদ্ধসাজ পরাইয়া স্বামীকে রণক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিত- আর বাঙালির মেয়ে কি বক্তৃতাসভাতেও পাঠাইতে পারে না।” নিঝরিণী কহিল, “ইংরেজি বক্ততা হইলে আমি ভয় করিতাম না, কিন্তু— থাক-না, অনেক লোক আসিবে, তোমার অভ্যাস নাই- শেষকালে-” শেষকালের কথাটা আমিও কি মাঝে মাঝে ভাবি নাই । রামমোহন রায়ের গানটা মনে পড়িতেছিল মনে করো শেষের সে দিন ভয়ংকর, বক্তার বক্ততা-অন্তে উঠিয়া দাড়াইবার সময় সভাপতি যদি হঠাৎ "দৃষ্টিহীন নাভীষ্মক্ষীণ হিমকলেবর অবস্থায় একেবারে নিকাত্তর হইয়া পড়েন, তবে কী গতি হইবে । এই-সকল কথা চিন্তা করিয়া পূর্বোক্ত পলাতক সভাপতিমহাশয়ের চেয়ে আমার স্বাস্থ্য যে কোনো অংশে ভালো ছিল, এমন কথা আমি বলিতে পারি না । বুক ফুলাইয়া স্ত্রীকে কহিলাম, “নিঝর, তুমি কি মনে কর—” স্ত্রী কহিল, “আমি কিছুই মনে করি না— কিন্তু আমার আজ ভাবি মাথা ধরিয়া আসিয়াছে, বোধ হয় জ্বর আসিবে, তুমি আজ আমাকে ফেলিয়া যাইতে পরিবে না ।” আমি কহিলাম, “সে আলাদা কথা ! তোমার মুখটা একটু লাল দেখাইতেছে বটে । ” সেই লালটা সভাস্থলে আমার দুরবস্থা কল্পনা কবিয়া লজ্জায়, অথবা আসন্ন জ্বরের আবেশে, সে কথা নিঃসংশয়ে পর্যালোচনা না কবিয়াই আমি ক্লাবের সেক্রেটারিকে স্ত্রাব পীডাব কথা জানাইয়া বলা বাহুলা, স্ত্রীর জ্বরভাব অতি সন্তুর ছাডিয়া গেল ! আমার অম্ভবাত্মা কহিতে লাগিল, “আর সব ভালো হইল, কিন্তু তোমার বাংলা বিদ্যা সম্বন্ধে তোমার স্ত্রার মনে এই-যে সংস্কার, এটা ভালো নয় । তিনি নিজেকে মন্ত বিদুষী বলিয়া ঠাওরাইয়াছেন— কোনোদিন বা মশারির মধ্যে নাইটস্কুল খুলিয়া তিনি তোমাকে বাংলা পড়াইবার চেষ্টা করিবেন ।” আমি কহিলাম, “ঠিক কথা— এই বেলা দৰ্প চূৰ্ণ না করিলে ক্ৰমে আর তাহাব নাগাল পাওয়া যাইবে না ।” সেই রাত্রেই তাহার সঙ্গে একটু খিটিমিটি বাধাইলাম ! অল্প শিক্ষা যে কিরূপ ভয়ংকর জিনিস, পোপের কাব্য হইতে তাহার উদাহরণ উদ্ধার কবিয়া তাহাকে শুনাইলাম । ইহাও বুঝাইলাম, কোনোমতে বানান এবং ব্যাকরণ বাচাইয়া লিখিলেই যে লেখা হইল তাহা নহে- আসল জিনিসটা হইতেছে আইডিয়া ! কাশিয়া বলিলাম, “ সেটা উপক্ৰমণিকায় পাওয়া যায় না- সেটার জন্য মাথা চাই ।” মাথা যে কোথায় আছে সে কথা তাহাকে স্পষ্ট কবিয বলি নাই, কিন্তু তবু বোধ হয় কথাটা অস্পষ্ট ছিল না ; আমি কহিলাম, “লিখিবার যোগ্য কোনো লেখা কোনো দেশে কোনোদিন কোনো শুনিমা নিবৰিণীক মেয়েলি তার্কিকতা চডিয়া উঠিল । সে বলিল, “কোন মেয়েরা লিখিতে পরিবে: না । মেমোরা এতই কি টান ।” আমি কহিলাম, “রাগা করিয়া কী কবিবে | দুষ্টান্ত দেখাও না ।" নিকারিণী কহিল, “তোমার মতো যদি আমার ইতিহাস পড থাকিত। তবে নিশ্চয়ই আমি ঢের দৃষ্টিান্ত দেখাইতে পারিতাম ।”