পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 NRV রবীন্দ্র-রচনাবলী ঝগড়া চলিতেছে- ও বড়ো গভীর । হরকুমার । ঝগড়া করাটা বুঝি এমনি করিয়া একেবারে অভ্যাস হইয়া গেছে— ভাই সবিয়া পডিয়াছেন, এখন পটল ! ফের মিথ্যা কথা ! তোমার সঙ্গে ঝগড়া করিয়া সুখ নাই- আমি চেষ্টাও কবি না। হরকুমার । আমি গোডাতেই হার মানিয়া যাই । পটল । বড়ো কমই করো । গোডায় হার না মানিয়া শেষে হার মানিলে কত খুশি হইতাম । বাত্রে শোবার ঘরের জানলা-দরজা খুলিয়া দিয়া যতীন অনেক কথা ভাবিল। যে মেয়ে আপনাব বাপ-মাকে না খাইতে পাইয়া মরিতে দেখিয়াছে, তাহার জীবনের উপর কী ভীষণ ছায়া পডিযছে । এই নিদারুণ ব্যাপারে সে কত বড়ো হইয়া উঠিয়াছে- তাহাকে লইয়া কি কৌতুক করা যায় । বিধাতা দয়া করিয, তাহাক বৃদ্ধিবৃত্তির উপরে একটা আবরণ ফেলিয়া দিয়াছেন— এই আবরণ যদি উঠিযা যায়। তবে অদূষ্ট্রের কন্দ্রলীলার কী ভীষণ চিহ্ন প্রকাশ হইয়া পড়ে । আজ মধ্যাহ্নে গাছের ফাক দিয়া যতীন যখন ফালুনের আকাশ দেখিতেছিল, দূর হইতে কঁঠালমূকুলের গন্ধ মৃদুতর হইয়া তাহার ঘাণকে আবিষ্ট করিয়া ধবিতেছিল, তখন তাহার মনটা মাধুর্যের কুহেলিকায় সমস্ত জগৎটাকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিয়াছিল— ঐ বুদ্ধিহীন বালিকা তাহার হরিণের মতো চোখ-দুটি লইয়া সেই সোনালি কুহেলিকা অপসাবিত কবিয়া দিয়াছে ; ফাল্লুনের এই কৃজন-গুঞ্জন-মৰ্মরের পশ্চাতে যে সংসার ক্ষুধাতৃষ্ণাতুর দুঃখকঠিন দেহ লইয়া বিরাট মূর্তিতে দাড়াইয়া আছে, উদঘাটিত যবনিকার শিল্পমাধুর্যের অন্তরালে সে দেখা দিল । পরদিন সন্ধ্যার সময় কুড়ানির সেই বেদন ধরিল । পটল তাড়াতাড়ি যতীনকে ডাকিয়া পাঠাইল । যতীন আসিয়া দেখিল, কষ্টে কুড়ানির হাতে পায়ে খিল ধরিতেছে, শরীর আড়ষ্ট । যতীন ঔষধ আনিতে পাঠাইয়া বােতলে করিয়া গরম জল আনিতে হুকুম করিল। পটল কহিল, “ভারি মন্ত ডাক্তার হইয়াছ, পায়ে একটু গরম তেল মালিশ করিয়া দাও-না ! দেখিতেছি না, পায়ের তোলো হিম হইয়া গেছে ।” যতীন রোগিণীর পায়ের তলায় গরম তেল সবেগে ঘবিয়া দিতে লাগিল । চিকিৎসা-ব্যাপারে বান্ত্রি অনেক হইল । হরকুমার কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিয়া বার বার কুড়ানির খবর লইতে লাগিলেন । উঠিয়াছে— ঘন ঘন কুড়ানির খবর লইবার তাৎপর্য তাই। যতীন কহিল, “হরকুমারবাবু ছটফট করিতেছেন, তুমি যাও পটল ।” পটল কহিল, “পরের দোহাই দিবে বৈকি। ছটফট কে করিতেছে তা বুঝিয়েছি। আমি গেলেই এখন তুমি’বাচো । এ দিকে কথায় কথায় লজ্জায় মুখচোখ লাল হইয়া উঠে- তোমার পেটে যে এত ছিল, তা কে বুঝিবে ।” যতীন । আচ্ছা, দোহাই তোমার, তুমি এইখানেই থাকে। রক্ষা করো"- তোমার মুখ বন্ধ হইলে বাচি । আমি ভুল বুঝিয়েছিলাম- হরকুমারবাবু বোধ হয় শান্তিতে আছেন, এরকম সুযোগ তার সর্বদা 6 R || কুন্ডানি আরাম পাইয়া যখন চোখ খুলিল পটল কহিল, “তোর চোখ খোলাইবার জন্য তোর বর যে আজ অনেকক্ষণ ধরিয়া তোকে পায়ে ধরিয়া সাধিয়াছে- আজি তাই বুঝি এত দেরি করিলি । ছিঃ ছি, ওঁর পায়ের ধুলা নে ৷” কুড়ানি কর্তব্যবোধে তৎক্ষণাৎ গভীরভাবে যতীনের পায়ের ধূলা লইল । যতীন দ্রুতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেল । তাহার পরদিন হইতে যতীনের উপরে রীতিমত উপদ্রব আরম্ভ হইল । যতীন খাইতে বসিয়াছে, এমন সময় কুড়ানি আসিয়া অমানবদনে পাখা দিয়া তাহার মাছি তাড়াইতে প্ৰবৃত্ত হইল।। যতীন বান্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “থাক থাক, কাজ নাই।” কুড়ানি এই নিষেধে বিস্মিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া পশ্চাদবর্তী ঘরের দিকে একবার চাহিয়া দেখিল- তাহার পরে আবার পুনশ্চ পাখা দোলাইতে