পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓig€ነB.. 8.98 মন্মথ । আমার নিজের সম্বন্ধে হলে আমি নিঃশব্দে সহ্য করতেম। কিন্তু ছেলেকে আমি মাটি করতে পারি না । যে ছেলে চাবা-মাত্রই পায়, চাবার পূর্বেই যার অভাবমোচন হতে থাকে, সে নিতান্ত দূৰ্ভাগা । ইচ্ছা দমন করতে না শিখে কেউ কোনো কালে সুখী হতে পারে না । বঞ্চিত হয়ে ধৈৰ্যরক্ষা করবার যে বিদ্যা, আমি তাই ছেলেকে দিতে চাই, ঘড়ি ঘড়ির-চেন জোগাতে চাই নে । শশধর । সে তো ভালো কথা, কিন্তু তোমার ইচ্ছামাত্ৰেই তো সংসারের সমস্ত বাধা তখনই ধূলিসাৎ হবে না । সকলেরই যদি তোমার মতো সদবুদ্ধি থাকত তা হলে তো কথাই ছিল না ; তা যখন নেই তখন সাধুসংকল্পকেও গায়ের জোরে চালানো যায় না, ধৈৰ্য চাই। স্ত্রীলোকের ইচ্ছার একেবারে উলটামুখে চলাবার চেষ্টা করলে অনেক বিপদে পড়বে— তার চেয়ে পাশ কাটিয়ে একটু ঘুরে গেলে সুবিধামত ফল পাওয়া যায়। বাতাস যখন উলটা ব্যয় জাহাজের পাল তখন আড় করে রাখতে হয়, নইলে চলা অসম্ভব । মন্মথ । তাই বুঝি তুমি গৃহিণীর সকল কথাতেই সায় দিয়ে যাও । ভীরু ! শশধর । তোমার মতো অসমসাহস আমার নেই । যার ঘরকন্নার অধীনে চব্বিশ ঘণ্টা বাস করতে হয় তাকে ভয় না করব তো কাকে করব । নিজের স্ত্রীর সঙ্গে বীরত্ব করে লাভ কী । আঘাত করলেও কষ্ট, আঘাত পেলেও কষ্ট । তার চেয়ে তর্কের বেলায় গৃহিণীর মতকে সম্পূর্ণ অকাট্য বলে স্বীকার করে কাজের বেলায় নিজের মত চালানোই সৎপরামর্শ- গোয়ার্ভূমি করতে গেলেই মুশকিল বাধে । মন্মথ । জীবন যদি সুদীর্ঘ হত। তবে ধীরেন্সুন্থে তোমার মতে চলা যেত, পরমায়ু যে অল্প । শশধর । সেইজন্যই তো ভাই, বিবেচনা করে চলতে হয় । সামনে একটা পাথর পড়লে যে লোক ঘুরে না গিয়ে সেটা ডিঙিয়ে পথ সংক্ষেপ করতে চায়, বিলম্ব তারই অদৃষ্ট আছে। কিন্তু তোমাকে এ-সকল বলা বৃথা- প্রতিদিনই তো ঠেকছে, তবু যখন শিক্ষা পােচ্ছ না। তখন আমার উপদেশে ফল নেই। তুমি এমনি ভাবে চলতে চাও, যেন তোমার স্ত্রী বলে একটা শক্তির অক্তিত্ব নেই- অথচ তিনি যে আছেন সে সম্বন্ধে তোমার লেশমাত্র সন্দেহ থাকবার কোনো কারণ দেখি নে । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দাম্পত্য কলহে চৈব বহুবারান্তে লঘুক্রিয়া- শাত্রে এইরূপ লেখে। কিন্তু দম্পতিবিশেষে ইহার ব্যতিক্রম ঘটে, অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাহা অস্বীকার করেন না । মন্মথবাবুর সহিত তাহার স্ত্রীর মধ্যে মধ্যে যে বাদপ্রতিবাদ ঘটিয়া থাকে তাহা নিশ্চয়ই কলহ, তবু তাহার আরম্ভও বহু নহে, তাহার ক্রিয়াও লঘু নহে- ঠিক অজাযুদ্ধের সঙ্গে তাহার তুলনা করা চলে না | কয়েকটি দৃষ্টান্ত জ্বারা এ কথার প্রমাণ হইবে। মন্মথবাবু কহিলেন, “তোমার ছেলেটিকে যে বিলাতি পোশাক পরাতে আরম্ভ করেছ, সে আমার পছন্দ নয় ।” বিধু কহিলেন, “পছন্দ বুকি একা তোমারই আছে । আজকাল তো সকলেই ছেলেদের ইংরেজি কাপড় ধরিয়েছে।” মন্মথ হাসিয়া কহিলেন, “সকলের মতেই যদি চলবে। তবে সকলকে ছেড়ে একমাত্র আমাকেই বিবাহ করলে কেন ।” বিধু। তুমি যদি কেবল নিজের মতেই চলবে। তবে একা না থেকে আমাকেই বা তোমার বিবাহ করবার কী দরকার ছিল । মন্মথ । নিজের মত চালাবার জন্যও যে অন্য লোকের দরকার হয় । বিধু। নিজের বোঝা বহাবার জন্য ধোবার দরকার হয় গাধাকে, কিন্তু আমি তো আরমন্মথ। (জিব কটিয়া) আরে রাম রাম, তুমি আমার সংসার-মরুভূমির আরব ঘোড়া । কিন্তু সে প্ৰাণীবৃত্তান্তের তর্ক এখন থাক । তোমার ছেলেটিকে সাহেব করে তুলো না ।