পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

'Neal 8心> করিয়া সমস্ত সহ্য করিয়া গিয়াছিল। কিন্তু আজ বেণুর মার কথা শুনিয়া তাহার বুক ভাঙিয়া গেল । সে বুঝিতে পারিল, বড়োমানুষের ঘরে মাস্টারের পদবীট কী। গোয়ালঘরে ছেলেকে দুধ জোগাইবার যেমন গোরু আছে তেমনি তাহকে বিদ্যা জোগাইবার একটা মাস্টারও রাখা হইয়াছে’- ছাত্রের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ আত্মীয়তার সম্বন্ধ স্থাপন এতবড়ো একটা স্পর্ধ যে, বাড়ির চাকর হইতে গৃহিণী পর্যন্ত কেহই তাহা সহ্য করিতে পারে না, এবং সকলেই সেটাকে স্বার্থসাধনের একটা চাতুরী বলিয়াই জানে । হরলাল কম্পিত্যকণ্ঠে বলিল, “মা, বেণুকে আমি কেবল পড়াইব, তাহার সঙ্গে আমার আর-কোনো সম্পর্ক থাকিবে না ।” সেদিন বিকালে বেণুর সঙ্গে তাহার খেলিবার সময়ে হরলাল কলেজ হইতে ফিরিলই না । কেমন করিয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া সে সময় কাটাইল তাহা সেই জানে। সন্ধ্যা হইলে যখন সে পড়াইতে আসিল তখন বেণু মুখ ভার করিয়া রহিল। হরলাল তাহার অনুপস্থিতির কোনো জবাবদিহি না করিয়া পড়াইয়া গেল- সেদিন পড়া সুবিধামত হইলই না । হরলাল প্রতিদিন রাত্ৰি থাকিতে উঠিয়া তাহার ঘরে বসিয়া পড়া করিত। বেণু সকালে উঠিয়াই মুখ ধুইয়া তাহার কাছে ছুটিয়া যাইত । বাগানে বাধানো চৌবাচ্ছায় মাছ ছিল । তাহাদিগকে মুড়ি খাওয়ানো ইহাদের এক কাজ ছিল । বাগানের এক কোণে কতকগুলা পাথর সাজাইয়া, ছোটো ছোটো রাস্তা ও ছোটাে গেট ও বেড়া তৈরি করিয়া বেণু বালখিল্য ঋষির আশ্রমের উপযুক্ত একটি অতি ছোটাে বাগান বসাইয়াছিল । সে বাগানে মালীর কোনো অধিকার ছিল না । সকালে এই বাগানের চর্যা করা তাহদের দ্বিতীয় কাজ । তাহার পরে রৌদ্র বেশি হইলে বাড়ি ফিরিয়া বেণু হরলালের কাছে পড়িতে বসিত । কাল সায়াহ্নে যে গল্পের অংশ শোনা হয় নাই সেইটো শুনিবার জন্য আজ বেণু যথাসাধ্য ভোরে উঠিয়া বাহিরে চুটিয়া আসিয়াছিল। সে মনে করিয়াছিল, সকালে ওঠায় সে আজ মাস্টারমশায়কে বুঝি জিতিয়াছে। ঘরে আসিয়া দেখিল, মাস্টারমশায় নাই। দরোয়ানকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, মাস্টারমশায় বাহির হইয়া গিয়াছেন । সেদিনও সকালে পড়ার সময় বেণু ক্ষুদ্র হৃদয়টুকুর বেদনা লইয়া মুখ গভীর করিয়া রহিল। সকালবেলায় হরলাল কেন যে বাহির হইয়া গিয়াছিল তাহা জিজ্ঞাসাও করিল না। হরলাল বেণুর মুখের দিকে না চাহিয়া বইয়ের পাতার উপর চোখ রাখিয়া পড়াইয়া গেল । বেণু বাড়ির ভিতরে তাহার মার কাছে যখন খাইতে বসিল তখন তাহার মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাল বিকাল হইতে তোর কী মুছে বল দেখি। মুখ ছাড়ি কবিয়া আছস কো— ভালো করিয়া খাইতেছিল না-বাপারখান "ן বেণু কোনো উত্তর করিল না । আহারের পর মা তাহাকে কাছে টানিয়া আনিয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া অনেক আদর করিয়া যখন তাহাকে বার বার প্রশ্ন করিতে লাগিলেন তখন সে আর থাকিতে পারিল না— যুঁপাইয়া কাদিয়া উঠিল। বলিল, “মাস্টারমশায়-” মা কহিলেন, “মাস্টারমশায় কী ।” বেণু বলতে পারল না মাস্টারমশায় কী কবিয়াছেন। কী যে অভিযোেগ তারা ভাষায় ব্যক্ত করা ননীবালা কহিলেন, “মাস্টারমশায় বুঝি তোর মার নামে তোর কাছে লাগাইয়াছেন ৷” সে কথার কোনো অর্থ বুঝিতে না পারিয়া বেণু উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল । (? ইতিমধ্যে বাড়িতে অধরবাবুর কতকগুলা কাপড়চােপড় চুরি হইয়া গেল। পুলিসকে খবর দেওয়া হইল । পুলিস খানাতল্লাসিতে হরলালেরও বাক্স সন্ধান করিতে ছাড়িল না। রতিকান্ত নিতান্তই নিরীহভাবে বলিল, “যে লোক লইয়াছে সে কি আর মাল বাক্সর মধ্যে রাখিয়াছে।”