পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Գ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী জীবনকে লোহার মুঠিতে আঁটিয়া পিষিয়া ধরিয়াছিল, হরলাল তাহাকে আর কিছুমাত্র স্বীকার করিল না- মুক্তি অনন্ত আকাশ পূর্ণ করিয়া.আছে, শান্তির কোথাও সীমা নাই। এই অতি সামান্য হরলালকে বেদনার মধ্যে, অপমানের মধ্যে, অন্যায়ের মধ্যে বন্দী করিয়া রাখিতে পারে এমন শক্তি বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের কোনো রাজা-মহারাজারও নাই । যে আতঙ্কে সে আপনাকে আপনি বাধিয়াছিল তাহা সমস্তই খুলিয়া গেল। তখন হরলাল আপনার বন্ধনমুক্ত হৃদয়ের চারি দিকে অনন্ত আকাশের মধ্যে অনুভব করিতে লাগিল, যেন তাহার সেই দরিদ্র মা দেখিতে দেখিতে বাড়িতে বাড়িতে বিরাটরাপে সমন্ত অন্ধকার জুডিয়া বসিতেছেন। তাহাকে কোথাও ধরিতেছে না। কলিকাতার রাস্তাঘাট বাড়িঘর দোকানবাজার একটু একটু করিয়া তাহার মধ্যে আচ্ছন্ন হইয়া লুপ্ত হইয়া যাইতেছে- বাতাস ভরিয়া গেল, আকাশ ভরিয়া উঠিল, একটি একটি করিয়া নক্ষত্র তাহার মধ্যে মিলাইয়া গেলা- হরলালের শরীরমনের সমস্ত বেদনা, সমস্ত ভাবনা, সমস্ত চেতনা তাহার মধ্যে অল্প অল্প করিয়া নিঃশেষ হইয়া গেল- ঐ গেল, তপ্ত বাম্পের বুদবুদ একেবারে ফাটিয়া গেল- এখন আর অন্ধকারও নাই, আলোকও নাই, রহিল কেবল একটি প্রগাঢ় পরিপূর্ণতা । গির্জার ঘড়িতে একটা বাজিল । গাড়োয়ান অন্ধকার ময়দানের মধ্যে গাড়ি লইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে বিরক্ত হইয়া কহিল, “বাবু, ঘোড়া তো আর চলিতে পারে না- কোথায় যাইতে হইবে বলে ।” কোনো উত্তর পাইল না । কোঁচবাক্স হইতে নামিয়া হরলালকে নাড়া দিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল। উত্তর নাই । তখন ভয় পাইয়া গাড়োয়ান পরীক্ষা করিয়া দেখিল হরলালের শরীর আড়ষ্ট, তাহার নিশ্বাস বাহিতেছে না ।

  • কোথায় যাইতে হইবে হরলালের কাছ হইতে এই প্রশ্নের আর উত্তর পাওয়া গেল না ।

আষাঢ়-শ্ৰাবণ ১৩১৪ ୧୫୧୪ S অমাবস্যার নিশীথ রাত্রি । মৃত্যুঞ্জয় তাত্রিক মতে তাহদের বহুকালের গৃহদেবতা জয়কালীর পূজায় বসিয়াছে। পূজা সমাধা করিয়া যখন উঠিল তখন নিকটস্থ আমবাগান হইতে প্ৰত্যুষের প্রথম কাক ডাকিল । মৃত্যুঞ্জয় পশ্চাতে ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ রহিয়াছে। তখন সে একবার দেবীর চরণতলে মন্তক ঠেকাইয়া তাহার আসন সরাইয়া দিল । সেই আসনের নীচে হইতে একটি কঁঠালকাঠের বাক্স বাহির হইল। পৈাতায় চাবি বাধা ছিল। সেই চাবি লােগাইয়া মৃত্যুজয় বাক্সটি খুলিল। খুলিবামাত্রই চমকিয়া উঠিয়া মাথায় করাঘাত করিল। মৃত্যুঞ্জয়ের অন্দরের বাগান প্রাচীর দিয়া ঘেরা। সেই বাগানের এক প্রান্তে বড়ো বড়ো গাছের ছায়ার অন্ধকারে এই ছোটাে মন্দিরটি । মন্দিরে জয়কালীর মূর্তি ছাড়া আর-কিছুই নাই ; তাহার প্রবেশদ্বার একটিমাত্র। মৃত্যুজয় বাক্সটি লইয়া অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করিয়া দেখিল। মৃত্যুজয় বাক্সটি খুলিবার পূর্বে তাহা বন্ধই ছিল-- কেহ তাহা ভাঙে নাই। মৃত্যুজয় দশবার করিয়া প্রতিমার চারিদিকে ঘুরিয়া হাতড়াইয়া দেখিল- কিছুই পাইল না। পাগলের মতো হইয়া মন্দিরের দ্বার খুলিয়া ফেলিলমানুহ আল ফুটিতেছে। মন্দিরের চার দিকে মৃত্যুন্ধর ঘূর্দিয়া ঘুরিয়া বৃথা আমাসে জিয়া वछ्ॉ२८ठ