পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ԳԵր রবীন্দ্র-রচনাবলী দক্ষিণে কিছুদূর যাইতেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে আসিয়া পড়িল। সেখানে সে বেতবাড়ি ভেদ করিয়া চলা একেবারে অসাধ্য । যাহা হউক, মৃত্যুজয় ঠিক করিল, এই গাছটাকে কোনোমতে হারাইলে চলিবে R || . এই গাছের কাছে ফিরিয়া আসিবার সময় গাছের অন্তরাল দিয়া অনতিদূরে একটা মন্দিরের চুড়া দেখা গেল। সেই দিকের প্রতি লক্ষ করিয়া মৃত্যুজয় এক ভাঙা মন্দিরের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল । দেখিল, নিকটে একটা চুল্লি, পোড়া কাঠ আর ছাই পড়িয়া আছে। অতি সাবধানে মৃত্যুজয় ভগ্নীদ্বার মন্দিরের মধ্যে উকি মারিল । সেখানে কোনো লোক নাই, প্রতিমা নাই, কেবল একটি কম্বল, কমণ্ডলু আর গেরুয়া উত্তরীয় পড়িয়া আছে। তখন সন্ধ্যা আসন্ন হইয়া আসিয়াছে ; গ্রাম বহুদূরে, অন্ধকারে বনের মধ্যে পথ সন্ধান করিয়া যাইতে পরিবে কি না, তাই এই মন্দিরে মনুষ্যবসতির লক্ষণ দেখিয়া মৃত্যুজয় খুশি হইল। মন্দির, হইতে একটি বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড ভাঙিয়া দ্বারের কাছে পড়িয়া ছিল ; সেই পাথরের উপরে বসিয়া নতশিরে ভাবিতে ভাবিতে মৃত্যুজয় হঠাৎ পাথরের গায়ে কী যেন লেখা দেখিতে পাইল। কুঁকিয়া পড়িয়া দেখিল একটি চক্র আঁকা, তাহার মধ্যে কতক স্পষ্ট কতক লুপ্তপ্রায় ভাবে নিম্নলিখিত সাংকেতিক অক্ষর লেখা Wi এই চক্রটি মৃত্যুঞ্জয়ের সুপরিচিত । কত অমাবস্য-রাত্রে পূজাগৃহে সুগন্ধ ধূপের ধূমে ঘূতদীপালোকে তুলট কাগজে অঙ্কিত এই চক্ৰচিহ্নের উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া রহস্যভেদ করিবার জন্য একাগ্রামনে সে দেবীর প্রসাদ যাচুঞা করিয়াছে। আজ অভীষ্টসিদ্ধির অত্যন্ত সন্নিকটে আসিয়া তাহার সর্বাঙ্গ যেন কঁাপিতে লাগিল। পাছে তীরে আসিয়া তরী ডোবে, পাছে সামান্য একটা ভুলে তাহার সমস্ত নষ্ট হইয়া যায়, পাছে সেই সন্ন্যাসী পূর্বে আসিয়া সমস্ত উদ্ধার করিয়া লইয়া গিয়া থাকে, এই আশঙ্কায় তাহার বুকের মধ্যে তোলপাড় করিতে লাগিল । এখন যে তাহার কী কর্তব্য তাহা সে ভাবিয়া পাইল না । তাহার মনে হইল, সে হয়তো তাহার ঐশ্বর্যভাণ্ডারের ঠিক উপরেই বসিয়া আছে, অথচ কিছুই জানিতে *२८ठCछ क्रा । বসিয়া বসিয়া সে কালীনাম জপ করিতে লাগিল ; সন্ধ্যার অন্ধকার নিবিড় হইয়া আসিল ; ঝিল্লির ধ্বনিতে বনভূমি মুখর হইয়া উঠিল । (? এমন সময় কিছুদূর ঘন বনের মধ্যে অগ্নির দীপ্তি দেখা গেল। মৃত্যুজয় তাহার প্রান্তরাসন ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল আর সেই শিখা লক্ষ্য করিয়া চলিতে লাগিল । বহুকষ্টে কিছুদূর গিয়া একটা অশথগাছের গুড়ির অন্তরাল হইতে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, তাহার সেই পরিচিত সন্ন্যাসী অগ্নির আলোকে সেই তুলটের লিখন মেলিয়া একটা কাঠি দিয়া ছাইয়ের উপরে একমনে অঙ্ক কবিতেছে । মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে সেই পৈতৃক তুলটের লিখন ! আরো ভণ্ড, চোর ! এইজন্যই সে মৃত্যুজয়কে শোক করিতে নিষেধ করিয়াছিল বটে !