পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 br S. রবীন্দ্র-রচনাবলী নিবৃত্ত করিয়া যাওয়াই ভালো ৷ চিহ্নগুলা লইয়া অনেক আলোচনা করিলাম ; কোনো ফল হইল না । বার বার মনে হইতে লাগিল, কেন সে কাগজখানা পুড়াইয়া ফেলিলাম। সেখানা রাখিলেই বা ক্ষতি কী छिळ्न । “তখন আবার আমার সেই জন্মগ্রামে গেলাম । আমাদের পৈতৃক ভিটার নিতান্ত দুরবস্থা দেখিয়া মনে করিলাম, আমি সন্ন্যাসী, আমার ধনরত্বে কোনো প্রয়োজন নাই, কিন্তু এই গরিবরা তো গহী, সেই গুপ্ত সম্পদ ইহাদের জন্য উদ্ধার করিয়া দিলে তাহাতে দোষ নাই । “সেই লিখন কোথায় আছে জানিতাম, তাহা সংগ্ৰহ করা আমার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন হইল না । “তাহার পরে একটি বৎসর ধরিয়া এই কাগজখানা লইয়া এই নির্জন বনের মধ্যে গণনা করিয়াছি আর সন্ধান করিয়াছি । মনে আর কোনো চিন্তা ছিল না । যত বারংবার বাধা পাইতে লাগিলাম ততই উত্তরোত্তর আগ্রহ আরো বাড়িয়া চলিল- উন্মত্তের মতো অহােরাত্র এই এক অধ্যবসায়ে নিবিষ্ট রহিলাম । “ইতিমধ্যে কখন তুমি আমার অনুসরণ করিতেছ। তাহা জানিতে পারি নাই। আমি সহজ অবস্থায় থাকিলে তুমি কখনোই নিজেকে আমার কাছে গোপন রাখিতে পারিতে না ; কিন্তু আমি তন্ময় হইয়া ছিলাম; বাহিরের ঘটনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিত না । “তাহার পরে, যাহা খুজিতেছিলাম আজ এইমাত্র তাহা আবিষ্কার করিয়াছি। এখানে যাহা আছে পৃথিবীতে কোনো রাজরাজেশ্বরের ভাণ্ডারেও এত ধন নাই । আর একটিমাত্র সংকেত ভেদ করিলেই সেই ধন পাওয়া যাইবে । “এই সংকেতটিই সর্বাপেক্ষা দুরূহ। কিন্তু এই সংকেতও আমি মনে মনে ভেদ করিয়াছি । সেইজনাই “পাইয়াছি বলিয়া মনের উল্লাসে চিৎকার করিয়া উঠিয়াছিলাম । যদি ইচ্ছা করি তবে আর-এক দণ্ডের মধ্যে সেই স্বর্ণমাণিক্যের ভাণ্ডারের মাৰুঃখানে গিয়া দাড়াইতে পারি।” মৃত্যুঞ্জয় শংকরের পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “তুমি সন্ন্যাসী, তোমার তো ধনের কোনো প্রয়োজন নাই- আমাকে সেই ভাণ্ডারের মধ্যে লইয়া যাও । আমাকে বঞ্চিত করিয়ো না ।” শংকর কহিলেন, “আজ আমার শেষ বন্ধন মুক্ত হইয়াছে । তুমি ঐ-যে পাথর ফেলিয়া আমাকে মারিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিলে, তাহার আঘাত আমার শরীরে লাগে নাই, কিন্তু তাহা আমার মোহােবরণকে ভেদ করিয়াছে। তৃষ্ণার করালমূর্তি আজ আমি দেখিলাম । আমার শুরু পরমহংসদেবের নিগঢ়ি প্রশান্ত হাস্য’ এতদিন পরে আমার অন্তরের কল্যাণদীপে অনির্বাণ আলোকশিখা জ্বালাইয়া ड्रलिब्न ।" মৃত্যুঞ্জয় শংকরের পা ধরিয়া পুনরায় কাতর স্বাবে কহিল, “তুমি মুক্ত পুরুষ, আমি মুক্ত নহি, আমি মুক্তি চাহি না, আমাকে এই ঐশ্বর্য হইতে বঞ্চিত করিতে পরিবে না ।” সন্ন্যাসী কহিলেন, “বৎস, তবে তুমি তোমার এই লিখনটি লও। যদি ধন খুজিয়া লইতে পার তবে व्नदेया ।” এই বলিয়া তাহার যষ্টি ও লিখনপত্র মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে রাখিয়া সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন। মৃত্যুজয় কহিল, “আমাকে দয়া করো, আমাকে ফেলিয়া যাইয়ো না- আমাকে দেখাইয়া দাও।” কোনো উত্তর পাইল না । তখন মৃত্যুঞ্জয় যষ্টির উপর ভর করিয়া হাতড়াইয়া সুরঙ্গ হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু পথ অত্যন্ত জটিল, গোলকধাঁধার মতো, বার বার বাধা পাইতে লাগিল। অবশেষে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ক্লান্ত হইয়া এক জায়গায় শুইয়া পড়িল এবং নিদ্ৰা আসিতে বিলম্ব হইল না । ঘুম হইতে যখন জাগিল তখন রাত্রি কি দিন কি কত বেলা তাহা জানিবার কোনো উপায় ছিল না । অত্যন্ত ক্ষুধা বোধ হইলে মৃত্যুজয় চাদরের প্রান্ত হইতে চিড়া খুলিয়া লইয়া খাইল । তাহার পর আর-একবার হাতড়াইয়া সুরঙ্গ হইতে বাহির হইবার পথ খুঁজিতে লাগিল। নানা স্থানে বাধা পাইয়া বসিয়া পড়িল । তখন চিৎকার করিয়া ডাকিল, “ওগো সন্ন্যাসী, তুমি কোথায় ।”