পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8&O রবীন্দ্র-রচনাবলী কেবল ঘরের কাজ নহে, তালুক ব্ৰহ্মাত্র অল্পসল্প যা-কিছু এখনো বাকি আছে তাহার হিসাবপত্র দেখা, খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করা, সমস্ত রাসমণিকে করিতে হয় । তহসিল প্রভৃতি সম্বন্ধে পূর্বে এত কষাকষি কোনোদিন ছিল না- ভবানীচরণের টাকা অভিমন্যুর ঠিক উলটা, সে বাহির হইতেই জানে, প্ৰবেশ করিবার বিদ্যা তাহার জানা নাই । কোনোদিন টাকার জন্য কাহাকেও তাগিদ করিতে তিনি একেবারেই অক্ষম । রাসমণি নিজের প্রাপ্য সম্বন্ধে কাহাকে সিকি পয়সা রেয়াত করেন না । ইহাতে প্ৰজারা তাহাকে নিন্দা করে, গোমস্তাগুলো পর্যন্ত তাহার সতর্কতার জ্বালায় অস্থির হইয়া তাহার বংশোচিত ক্ষুদ্রাশয়তার উল্লেখ করিয়া তাহাকে গালি দিতে ছাড়ে না। এমন-কি, তাহার স্বামীও তাহার কৃপণতা ও তাহার কর্কশতাকে তাহদের বিশ্ববিখ্যাত পরিবারের পক্ষে মানহানিজনক বলিয়া কখনো কখনো মৃদুস্বরে আপত্তি করিয়া থাকেন । এ-সমস্ত নিন্দা ও ভৎসনা তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া নিজের নিয়মে কাজ করিয়া চলেন, দোষ সমস্তই নিজের ঘাড়ে লন ; তিনি গরিবের ঘরের মেয়ে, তিনি বড়োমানুষিয়ানার কিছুই বোঝেন না, এই কথা বার বার স্বীকার করিয়া ঘরে বাহিরে সকল লোকের কাছে অপ্রিয় হইয়া, আঁচলের প্রান্তটা কবিয়া কোমরে জড়াইয়া ঝড়ের বেগে কাজ করিতে থাকেন ; কেহ তাহকে বাধা দিতে সাহস করে না ! স্বামীকে কোনোদিন তিনি কোনো কাজে ডাকা দূরে থােক, তাহার মনে মনে এই ভয় সর্বদা ছিল পাছে ভবানীচরণ সহসা কর্তৃত্ব করিয়া কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করিয়া বসেন। “তোমাকে কিছুই ভাবিতে হইবে না, এ-সব কিছুতে তোমার থাকার প্রয়োজন নাই' এই বলিয়া সকল বিষয়েই স্বামীকে নিরুদ্যম করিয়া রাখাই তাহার একটা প্রধান চেষ্টা ছিল। স্বামীরও আজন্মকাল সেটা সুন্দররাপে অভ্যন্ত থাকাতে সে বিষয়ে স্ত্রীকে অধিক দুঃখ পাইতে হয় নাই । রাসমণির অনেক বয়স পর্যন্ত সন্তান হয় নাই— এই তাহার অকৰ্মণ্য সরলপ্রকৃতি পরমুখাপেক্ষী স্বামীটিকে লইয়া তাহার পত্নী প্রেম ও মাতৃস্নেহ দুই মিটিয়াছিল। ভবানীকে তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত বালক বলিয়াই দেখিতেন । কাজেই শাশুড়ির মৃত্যুর পর হইতে বাড়ির কর্তা এবং গৃহিণী উভয়েরই কাজ তাহাকে একলাই সম্পন্ন করিতে হইত। গুরুঠাকুরের ছেলে এবং অন্যান্য বিপদ হইতে স্বামীকে রক্ষা করিবার জন্য তিনি এমনি কঠোরভাবে চলিতেন যে, তাহার স্বামীর সঙ্গীরা তাহাকে ভারি ভয় করিত । প্রখরতা গোপন করিয়া রাখিবেন, স্পষ্ট কথাগুলোর ধারটুকু একটু নরম করিয়া দিবেন, এবং পুরুষমণ্ডলীর সঙ্গে যথোচিত সংকোচ রক্ষা করিয়া চলিবেন, সেই নারীজনোচিত সুযোগ তাহার ঘটিল না । এ পর্যন্ত ভবানীচরণ তাহার বাধ্যভাবেই চলিতেছিলেন । কিন্তু কালীপদর সম্বন্ধে রাসমণিকে মানিয়া চলা তাহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিল । তাহার কারণ এই রাসমণি ভবানীর পুত্রটিকে ভবানীচরণের নজরে দেখিতেন না । তাহার স্বামীর সম্বন্ধে তিনি ভাবিতেন, বেচারা করিবে কী, উহার দোষ কী, ও বড়োমানুষের ঘরে জন্মিয়াছে— ‘ওর তো উপায় নাই । এইজন্য তাহার স্বামী যে কোনোরূপ কষ্ট স্বীকার করবেন, ইহা তিনি আশাই করিতে পারিতেন না । তাই সহস্ৰ অভাব সত্ত্বেও প্ৰাণপণ শক্তিতে তিনি স্বামীর সমস্ত অভ্যন্ত প্রয়োজন যথাসম্ভব জোগাইয়া দিতেন। তাহার ঘরে বাহিরের লোকের সম্বন্ধে হিসাব খুবই কষা ছিল, কিন্তু ভবানীচরণের আহারে ব্যবহারে পারতপক্ষে সাবেক নিয়মের কিছুমাত্র ব্যত্যয় হইতে পারিত না । নিতান্ত টানাটানির দিনে যদি কোনো বিষয়ে কিছু ত্রুটি ঘটিত তবে সেটা সে অভাব্যবশত ঘটিয়াছে সে কথা তিনি কোনোমতেই স্বামীকে জানিতে দিতেন না- হয়তো বলিতেন, “ঐ রে, হতভাগা কুকুর খাবারে মুখ দিয়া সমস্ত নষ্ট করিয়া দিয়াছে ? বলিয়া নিজের কল্পিত অসতর্কতাকে ধিককার দিতেন । নয়তো লক্ষ্মীছাড়া নোটাের দোষেই নূতন-কোেনা কাপড়টা খোওয়া গিয়াছে বলিয়া তাহার বুদ্ধির প্রতি প্রচুর অশ্রদ্ধা প্ৰকাশ করিতেন- ভবানীচরণ তখন তাহার প্রিয় ভূতাটির পক্ষাবলম্বন করিয়া গৃহিণীর ক্ৰোধ হইতে তাহাকে বাচাইবার জন্য ব্যন্ত হইয়া উঠিতেন । এমন-কি, কখনো এমনও ঘটিয়াছে, যে কাপড় গৃহিণী কেনেন নাই এবং ভবানীচরণ চক্ষেও দেখেন নাই এবং যে কাল্পনিক কাপড়খানা হারাইয়া ফেলিয়াছে বলিয়া নাটবিহারী অভিযুক্ত- ভবানীচরণ অম্লানমুখে স্বীকার করিয়াছেন যে, সেই কাপড়