পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8公G রবীন্দ্র-রচনাবলী ভবানীচরণ ভিখারীর মতো তঁহার অন্নপূর্ণার দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রথমে বিস্তর অপ্রাসঙ্গিক কথা আলোচনা করিয়া অবশেষে এক সময়ে ধা করিয়া আপনার মনের ইচ্ছাটা বলিয়া ফেলিলেন । রাসমণি অত্যন্ত সংক্ষেপে বলিলেন, “পাগল হইয়াহু!” ভবানীচরণ চুপ করিয়া খানিকক্ষণ ভাবিতে লাগিলেন। তাহার পরে হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “আচ্ছা! দেখো, ভাতের সঙ্গে তুমি যে রোজ আমাকে ঘি আর পায়স দাও সেটার তো প্রয়োজন নাই ।” রাসমণি বলিলেন, “প্রয়োজন নাই তো কী ।” ভবানীচরণ কহিলেন, “কবিরাজ বলে, উহাতে পিত্ত বৃদ্ধি হয় ।” রাসমণি তীষ্মকভাবে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “তোমার কবিরাজ তো সব জানে ?” ভবানীচরণ কহিলেন, “আমি তো বলি রাত্রে আমার লুচি বন্ধ করিয়া ভাতের ব্যবস্থা করিয়া দিলে DB DKSSLD rE DBK DB SS রাসমণি কহিলেন, “পেট ভার করিয়া আজ পর্যন্ত তোমার তো কোনো অনিষ্ট হইতে দেখিলাম না । জন্মকাল হইতে লুচি খাইয়াই তো তুমি মানুষ ।” ভবানীচরণ সর্বপ্রকার ত্যাগাস্বীকার করিতেই প্ৰস্তুত- কিন্তু সে দিকে ভারি কড়াকড়ি । যিয়ের দর বাড়িতেছে। তবু লুচির সংখ্যা ঠিক সমানই আছে। মধ্যাহ্নভোজনে পায়সটা যখন আছেই। তখন দইটা না দিলে কোনো ক্ষতিই হয় না- কিন্তু বাহুল্য হইলেও এ বাড়িতে বাবুরা বরাবর দই পায়স খাইয়া আসিয়াছেন । কোনোদিন ভবানীচরণের ভোগে সেই চিরন্তন দধির অনটন দেখিলে রাসমণি কিছুতেই তাহা সহ্য করিতে পারেন না । অতএব গায়ে-হাওয়া-লাগানো সেই মোমমূর্তিটিই ভবানীচরণের দই-পায়স-ঘি-লুচির কোনো ছিদ্রপথ দিয়া যে প্রবেশ করিবে এমন উপায় দেখা গেল না । ভবানীচরণ তাহার গুরুপুত্রের বাসায় একদিন যেন নিতান্ত অকারণেই গেলেন এবং বিস্তর অপ্রাসঙ্গিক কথার পর সেই মেমের খবরটা জিজ্ঞাসা করিলেন । তাহার বর্তমান আর্থিক দুৰ্গতির কথা বগলাচরণের কাছে গোপন থাকিবার কোনো কারণ নাই তাহা তিনি জানেন, তবু আজ তাহার টাকা নাই বলিয়া ঐ একটা সামান্য খেলনা তিনি তাহার ছেলের জন্য কিনিতে পারিতেছেন না, এ কথার আভাস দিতেও তাহার যেন মাথা ছিড়িয়া পড়িতে লাগিল । তবু দুঃসহ সংকোচকেও অধঃকৃত করিয়া তিনি তাহার চাদরের ভিতর হইতে কাপড়ে-মোড়া একটি দামী পুরাতন জামিয়ার বাহির করিলেন । রুদ্ধপ্ৰায় কঠে। কহিলেন, “সময়টা কিছু খারাপ পডিয়াছে, নগদ টাকা হাতে বেশি নাই- তাই মনে করিয়াছি, এই জামিয়ারটি তোমার কাছে বন্ধক রাখিয়া সেই পুতুলটা কালীপদর জন্য লইয়া! যাইব ।” জামিয়ারের চেয়ে অল্প দামের কোনো জিনিস। যদি হইত। তবে বগলাচরণের বাধিত না- কিন্তু সে জানিত এটা হজম করিয়া উঠিতে পরিবে না- গ্রামের লোকেরা তো নিন্দা করিবেই, তাহার উপরে রাসমণির রসনা হইতে যাহা বাহির হইবে তাহা সরুস হইবে না। জামিয়ারটাকে পুনরায় চাদরের মধ্যে গোপন করিয়া হতাশ হইয়া ভবানীচরণকে ফিরিতে হইল । কালীপদ পিতাকে রোজ জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার সেই মেমের কী হইল।” ভবানীচরণ রোজই হাসিমুখে বলেন, “রোস- এখনই কী । সপ্তমী পূজার দিন আগে আসুক । প্রতিদিনই মুখে হাসি টানিয়া আনা দুঃসাধ্যকর হইতে লাগিল । আজ চতুর্থী। ভবানীচরণ অসময়ে অন্তঃপুরে কী একটা ছুতা করিয়া গেলেন । যেন হঠাৎ কথাপ্রসঙ্গে রাসমণিকে বলিয়া উঠিলেন, “দেখো, আমি কয়দিন হইতে লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছি, কালীপদার শরীরটা যেন দিনে দিনে খারাপ হইয়া যাইতেছে।” রাসমণি কহিলেন, “বালাই । খারাপ হইতে যাইবে কেন । ওর তো আমি কোনো অসুখ দেখি না।” ভবানীচরণ কহিলেন, “দেখ নাই ! ও চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কী যেন ভাবে ।” রাসমণি কহিলেন, “ও একদণ্ড চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে আমি তো বাচিতাম । ওর আবার ভাবনা ! কোথায় কী দুষ্টামি করির্তে হইবে, ও সেই কথাই ভাবে ।” দুর্গপ্রাচীরের এদিকটাতেও কোনো দুর্বলতা দেখা গেল না- পাথরের উপরে গোলার দাগও বসিল