পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q 88 করিয়া নিজে সাজাইয়া দিয়াছেন। কালীপদ জানিত তাহার অবর্তমানে কীেভুকপরায়ণ উপরতলার দল তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া থাকে । তাহার আর-কোনো ভাবনা ছিল না, কেবল তাহর বড়ো সংকোচ ছিল পাছে তাহার পিতামাতার কোনো মেহের নিদর্শন এই বিলুপকারীদের হাতে পড়ে ; তাহার মা তাহাকে যে খাবার জিনিসগুলি দিয়াছেন এ তাহার পক্ষে অমৃত- কিন্তু এ-সমতই তাহর দরিদ্র গ্ৰাম্যম্বরের আদরের ধন ; যে আধারে সেগুলি রক্ষিত সেই ময়দা দিয়া আঁটা সরা-ঢাকা হাঁড়ি, তাহার মধ্যেও শহরের ঐশ্বৰ্যসজার কোনো লক্ষণ নাই, তাহা কাচের পাত্র নয়, তাহা চিনামটির ভাণ্ডও নছে- কিন্তু এইগুলিকে কোনো শহরের ছেলে যে অবজ্ঞা করিয়া দেখিবে ইহা তাহর পক্ষে একেবারেই অসহ্য । আগের বারে তাহার এইসমস্ত বিশেষ জিনিসগুলিকে তক্তাপোশের নীচে পুরানো খবরের কাগজ প্রভৃতি চাপা দিয়া প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখিত । এবারে তালাচাবির আশ্ৰয় লইল । যখন সে পাচমিনিটের জন্যও ঘরের বাহিরে যাইত ঘরে তালা বন্ধ করিয়া যাইত । এটা সকলেরই চোখে লাগিল। শৈলেন বলিল, “ধনরত্ন তো বিতরি । ঘরে ঢুকিলে চোরের চক্ষে জল আসে- সেই ঘরে ঘন ঘন তালা পড়িতেছে- একেবারে দ্বিতীয় ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল হইয়া উঠিল দেখিতেছি। আমাদের কাহাকেও বিশ্বাস নাই- পাছে ঐ পাবনার হিটের চায়নাকোটন্টার লোভ সামলাইতে না পারি। ওহে রাধু, ওকে একটা ভদ্রগোছের নূতন কোট কিনিয়া না দিলে তো কিছুতেই চলিতেছে না । চিরকাল ওর ঐ একমাত্র কোটি দেখিতে দেখিতে আমার বিরক্ত ধরিয়া গেছে।” শৈলেন কোনােদিন কালীপদর ঐ লোনাধর চুনবালি-খাসা অন্ধকার ঘরটার মধ্যে প্রবেশ করে নাই। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিবার সময় বাহির হইতে দেখিলেই তাহার সর্বশরীর সংকুচিত হইয়া উঠিত। বিশেষত সন্ধ্যার সময় যখন দেখিত একটা টিমটিমে প্ৰদীপ লইয়া একলা সেই বায়ুশূন্য বন্ধ ঘরে কালীপদ গা ধুলিয়া বসিয়া বইয়ের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া পড়া করিতেছে তখন তাহার প্রাণ হাপাইয়া উঠিত। দলের লোককে শৈলেন বলিল, “এবারে কালীপদ কোন সাতরাজার-ধন মানিক আহরণ করিয়া আনিয়াছে সেটা তোমরা খুজিয়া বাহির করে।” এই কৌতুকে সকলেই উৎসাহ প্ৰকাশ করিল। কালীপদার ঘরের তলাটি নিতান্তই অল্প দামের তালা- তাহার নিষেধ খুব প্রবল নিষেধ নহেপ্রায় সকল চাবিতেই এ তালা খোলে। একদিন সন্ধ্যার সময় কালীপদ যখন ছেলে পড়াইতে গিয়াছে সেই অবকাশে জনদুই-তিন অত্যন্ত আমুদে ছেলে হাসিতে হাসিতে তালা খুলিয়া একটা লণ্ঠন হাতে তাহার ঘরে প্রবেশ করিল। তক্তাপোশের নীচে হইতে আচার চাটনি আমসত্ব প্রভৃতির ভাণ্ডগুলিকে আবিষ্কার করিল। কিন্তু সেগুলি যে বহুমূল্য গোপনীয় সামগ্ৰী তাহা তাহদের মনে হইল না । খুজিতে খুজিতে বালিশের নীচে হইতে রিসেমেত ঐক চাবি বাহির হইল। সেই চাবি দিয়া টিনের বাক্সটা খুলিতেই কয়েকটা ময়লা কাপড়, বই, খাতা, কঁচি, চুরি, কলম ইত্যাদি চোখে পড়িল । বাক্স বন্ধ করিয়া তাহারা চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে এমন সময়ে সমান্ত কাপড়াচোপড়ের নীচে রুমালে মোড়া একটা কী পদাৰ্থ বাহির হইল। রুমাল খুলিতেই ছেড়া কাপড়ের মোড়ক দেখা দিল। সেই মোড়কটি খোলা হইলে একটির পর আর-একটি প্রায় তিন-চারখানা কাগজের আবরণ ছাড়াইয়া কেলিয়া একখানি পঞ্চাশ টাকার নেট বাহির হইয়া পড়িল । এই নোটখানা দেখিয়া আর কেহ হাসি রাখিতে পারিল না । হে হো করিয়া উচ্চস্বরে হাসিয়া উঠিল । সকলেই স্থির করিল, এই নোটখানারই জন্যে কালীপদ ঘন ঘন ঘরে চাবি লগাইতেছে, পৃথিবীর কোনো লোককেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। লোকটার কৃপণতা এবং সন্দিন্তু প্ৰকৃতিতে শৈলেনের প্রসাদপ্রত্যাশী সহচরগুলি বিস্থিত হইয়া উঠিল । এমন সময় হঠাৎ মনে হইল, রান্তায় কালীপদর মতো যেন কাহার কাশি শোনা গেল। তৎক্ষণাৎ বাক্সটার ডালা বন্ধ করিয়া, নোটখানা হতে লইয়াই তাহারা উপরে দুটিল । একজন তাড়াতাড়ি দরজায় তালা লাগাইয়া দিল । শৈলেন সেই নোটখানা দেখিয়া অত্যন্ত হাসিল। পঞ্চাশ টাকা শৈলেনের কাছে কিছুই নয়, তবু এত টাকাও যে কালীপদার বাক্সে ছিল তাহা তাহার ব্যবহার দেখিয়া কেহ অনুমান করিতে পারিত না ।