পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G?to SR झीझ-झष्नावी ডাক্তার কহিলেন, “এ ঘর হইতে রোগীকে এখনই দোতলার কোনো ভালো ঘরে লইয়া যাওয়া উচিত। দিনরাত শুশুবার ব্যবস্থা করাও চাই।” শৈলেন রোগীকে তাহার নিজের ঘরে লইয়া গেল । তাহার সহচরদের সকলকে ভিড় করিতে নিষেধ করিয়া ঘর হইতে বিদায় করিয়া দিল। কালীপদার মাথায় বরফের টুলি লাগাইয়া নিজের হাতে বাতাস করিতে লাগিল । পূর্বেই বলিয়াছি, এই বাড়ির উপরতলার দলে পাছে কোনোপ্রকার অবজ্ঞা বা পরিহাস করে এইজন্য নিজের পিতামাতার সকল পরিচয় কালীপদ ইহাদের নিকট হইতে গোপন করিয়া চলিয়াছে । নিজে তাহাদের নামে যে চিঠি লিখিত তাহা সাবধানে ডাকঘরে দিয়া আসিত এবং ডাকঘরের ঠিকানাতেই তাহার নামে চিঠি আসিত- প্ৰত্যহ সে নিজে গিয়া তাহা সংগ্ৰহ করিয়া আনিত । কালীপদার বাড়ির পরিচয় লইবার জন্য আর-একবার তাহার বাক্স বুলিতে হইল। তাহার বাক্সের মধ্যে দুইতাড়া চিঠি ছিল। প্রত্যেক তাড়াটি অতিযত্নে ফিতা দিয়া বাধা । একটি তাড়াতে তাহার মাতার চিঠি- আর একটিতে তাহার পিতার । মায়ের চিঠি সংখ্যায় অল্পই, পিতার চিঠিই বেশি। চিঠিগুলি হাতে করিয়া আনিয়া শৈলেন দরজা বন্ধ করিয়া দিল এবং রোগীর বিছানার পাৰ্থে বসিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। চিঠিতে ঠিকানা পড়িয়াই একেবারে চমকিয়া উঠিল। শানিয়াড়ি, চৌধুরীবাড়ি, ছয় আনি ! নীচে নাম দেখিল, ভবানীচরণ দেবশৰ্মা । ভবানীচরণ চৌধুরী ! চিঠি রাখিয়া স্তৱ হইয়া বসিয়া সে কালীপদর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কিছুদিন পূর্বে একবার তাহার সহচরদের মধ্যে কে একজন বলিয়াছিল, তাহার মুখের সঙ্গে কালীপদর মুখের অনেকটা আদল আসে । সে কথাটা তাহার শুনিতে ভালো লাগে নাই এবং অন্য-সকলে তাহা একেবারে উড়াইয়া দিয়াছিল। আজ বুঝিতে পারিল, সে কথাটা অমূলক নহে। তাহার পিতামহরা দুই ভাই ছিলেনশ্যামাচরণ এবং ভবানীচরণ, এ কথা সে জানিত । তাহার পরবর্তীকালের ইতিহাস তাহদের বাড়িতে কখনো আলোচিত হয় নাই । ভবানীচরণের যে পুত্ৰ আছে এবং তাহার নাম কালীপদ তাহা সে জানিতই না । এই কালীপদ ! এই তাহার খুড়া ! শৈলেনের তখন মনে পড়িতে লাগিল, শৈলেনের পিতামহী, শ্যামাচরণের শ্ৰী যতদিন ধাঁচিয়া ছিলেন, শেষ পর্যন্ত পরামস্নেহে তিনি ভবানীচরণের কথা বলিতেন। ভবানীচরণের নাম করিতে র্তাহার দুই চক্ষে জল ভরিয়া উঠিত । ভবানীচরণ তাহার দেবার বটে, কিন্তু তাহার পুত্রের চেয়ে বয়সে ছোটাে- তাহাকে তিনি আপনি ছেলের মতোই মানুষ করিয়াছেন । বৈষয়িক বিপ্লবে যখন তাহারা স্বতন্ত্র হইয়া গেলেন, তখন ভবানীচরণের একটু খবর পাইবার জন্য তাহার বক্ষ তৃষিত হইয়া থাকিত । তিনি বার বার তাহার ছেলেদের বলিয়াছেন, ভবানীচরণ নিতান্ত অবুঝ ভালোমানুষ বলিয়া নিশ্চয়ই তোরা তাহাকে ফাকি দিয়াছিস- আমার শ্বশুর তাহাকে এত ভালোবাসিতেন, তিনি যে তাঁহাকে বিষয় হইতে বঞ্চিত করিয়া যাইবেন এ কথা আমি বিশ্বাস করিতে পারি না ।” তাহার ছেলেরা এ-সব কথায় অত্যন্ত বিরক্ত হইত এবং শৈলেনের মনে পড়িল সেও তাহার পিতামহীর উপর অত্যন্ত রাগ করিত । এমন-কি, পিতামহী তাহার পক্ষ অবলম্বন করিতেন বলিয়া ভবানীচরণের উপরেও তাহার ভারি রাগ হইত। বর্তমানে ভবানীচরণের যে এমন দরিদ্র অবস্থা তাহাও সে জানিত না- কালীপদার অবস্থা দেখিয়া সকল কথা সে বুঝিতে পারিল এবং এতদিন সহস্র প্রলোভন সত্ত্বেও কালীপদ যে তাহার অনুচরশ্রেণীতে ভরতি হয় নাই ইহাতে সে ভারি গীেরব অনুভব করিল। যদি দৈবাৎ কালীপদ তাহার অনুবতী হইত। তবে আজ যে তাহার লেজার সীমা থাকিত না। 8 শৈলেনের দলের লোকেরা এতদিন প্রত্যহই কালীপদকে পীড়ন ও অপমান করিয়াছে। এই বাসাতে তাহদের মাঝখানে কাকাকে শৈলেন রাখিতে পারিল না । ডাক্তারের পরামর্শ লইয়া অতিযত্নে তাহাকে একটা ভালো বাড়িতে স্থানান্তরিত করিল।