পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

sts (2 OG পারিত না । বিশেষত কালীপদ ইহা স্পষ্ট লক্ষা করিয়া দেখিয়াছে যে, এই প্রসঙ্গটা কিছুতেই শৈলেনের ভালো লাগে না । এমন-কি, সে ও বিশেষ একটু যেন উত্তেজিত হইয়া ভবানীচরণের যুক্তি খণ্ডন করিতে চেষ্টা করিত । অন্য সকল বিষয়েই ভবানীচবণ আর-সকলের মত মানিয়া লইতে প্ৰস্তুত আছেন- কিন্তু এই বিষয়টাতে তিনি কাহারও কাছে হার মানিতে পারেন না । তাহার মা লিখিতে পড়িতে জানিতেনতিনি নিজের হাতে তাহার পিতার উইল এবং অন্য দলিলটা বাক্সে বন্ধ করিয়া লোহার সিন্দুকে তুলিয়াছেন ; অথচ তাহার সামনেই মা যখন বাক্স খুলিলেন তখন দেখা গেল অন্য দলিলটা যেমন ছিল তেমনি আছে অথচ উইলটা নাই, ইহাকে চুরি বলা হইবে না তো কী । কালীপদ তাহকে ঠাণ্ডা করিবার জন্য বলিত, “তা, বেশ তো বাবা, যারা তোমার বিষয় ভোগ করিতেছে তারা তো তোমারই ছেলেরই মতো, তারা তো তোমারই ভাইপো । সে সম্পত্তি তোমার পিতার বংশেই রহিয়াছে- ইহাই কি কম সুখের কথা ।” শৈলেন এ-সব কথা বেশিক্ষণ সহিতে পারিত না, সে ঘর ছাড়িয়া উঠিয়া চলিয়া যাইত । কালীপদ মনে মনে পীড়িত হইয়া ভাবিত, শৈলেন হয়তো তাহার পিতাকে অর্থলোলুপ বিষয়ী বলিয়া মনে করিতেছে, অথচ তাহার পিতার মধ্যে বৈষয়িকতার নামগন্ধ নাই। এ কথা কোনোমতে শৈলেনকে বুঝাইতে পারিলে কালীপদ বড়োই আরাম পাইত । এতদিনে কালীপদ ও ভবানীচরণের কাছে শৈলেন আপনার পরিচয় নিশ্চয় প্রকাশ করিত। কিন্তু এই উইল-চুরির আলোচনাতেই তাহাকে বাধা দিল । তাহার পিতা পিতামহ যে উইল চুরি করিয়াছেন এ কথা সে কোনোমতেই বিশ্বাস করিতে চাহিল না, অথচ ভবানীচরণের পক্ষে পৈতৃক বিষয়ের ন্যায্য অংশ হইতে বঞ্চিত হওয়ার মধ্যে যে একটা নিষ্ঠুর অন্যায় আছে সে কথাও সে কোনোমতে অস্বীকার করিতে পারিল না । এখন হইতে এই প্রসঙ্গে কোনোপ্রকার তর্ক করা সে বন্ধ করিয়া দিল- একেবারে সে চুপ করিয়া থাকিস্ত— এবং যদি কোনো সুযোগ পাইত। তবে উঠিয়া চলিয়া যাইত । এখনো বিকালে একটু অল্প জ্বর আসিয়া কালীপদার মাথা ধরিত, কিন্তু সেটাকে সে রোগ বলিয়া গণ্যই করিত না । পড়ার জন্য তাহার মন উদবিগ্ন হইয়া উঠিল । একবার তাহার স্কলারশিপ ফাঁসকাইয়া গিয়াছে, আর তো সেরূপ হইলে চলিবে না । শৈলেনকে লুকাইয়া আবার সে পড়িতে আরম্ভ করিলএ সম্বন্ধে ডাক্তারের কঠোর নিষেধ আছে জানিয়াও সে তাহা অগ্রাহ্য করিল। ভবানীচরণকে কালীপদ কহিল, “বাবা, তুমি বাড়ি ফিরিয়া যাও- সেখানে মা একলা আছেন । আমি তো বেশ সারিয়া উঠিয়াছি।” শৈলেনও বলিল, “এখন আপনি গেলে কোনো ক্ষতি নাই। আর তো ভাবনার কারণ কিছু দেখি না। এখন যেটুকু আছে সে দুদিনেই সারিয়া যাইবে । আর আমরা তো আছি।” ভবানীচরণ কহিলেন, “সে আমি বেশ জানি ; কালীপদার জন্য ভাবনা করিবার কিছুই নাই। আমার কলিকাতায় আসিবার কোনো প্রয়োজনই ছিল না, তবু মন মানে কই ভাই। বিশেষত তোমার ঠাকরুনদিদি যখন যেটি ধরেন সে তো আর ছাড়াইবার জো নাই ।” শৈলেন হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরদা, তুমিই তো আদর দিয়া ঠাকরুনেদিদিকে একেবারে মাটি করিয়াছ ।” ভবানীচরণ হাসিয়া কহিলেন, “আচ্ছা ভাই, আচ্ছা, ঘরে যখন নাতবউ আসিবে তখন তোমার শাসনপ্রণালীটিা কিরকম কঠোর আকার ধারণ করে দেখা যাইবে ।” ভবানীচরণ একান্তভাবে রাসমণির সেবায় পালিত জীব । কলিকাতার নানাপ্রকার আরাম-আয়োজনও রাসমণির আদরযত্নের অভাব কিছুতেই পূরণ করিতে পারিতেছিল না। এই কারণে ঘরে যাইবার জন্য তাহাকে বড়ো বেশি অনুরোধ করিতে হইল না। সকালবেলায় জিনিসপত্র বাধিয়া প্ৰস্তুত হইয়াছেন এমন সময় কালীপদার ঘরে গিয়া দেখিলেন তাহার মুখচোখ অত্যন্ত লাল হইয়া উঠিয়াছে- তাহার গা যেন আগুনের মতো গরম ; কাল অর্ধেক রাত্রি সে লজিক মুখস্থ করিয়াছে, বাকি রাত্রি এক নিমেষের জন্যও ঘুমাইতে পারে নাই।