পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(OV রবীন্দ্র-রচনাবলী কালীপদার দুর্বলতা তো সারিয়া উঠে নাই, তাহার উপরে আবার রোগের প্রবল আক্রমণ দেখিয়া ডাক্তার বিশেষ চিন্তিত হইলেন। শৈলেনকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গিয়া বলিলেন, “এবার তো গতিক ভালো বোধ করিতেছি না ।” শৈলেন ভবানীচরণকে কহিল, “দেখো ঠাকুরদা, তোমারও কষ্ট হইতেছে, রোগীরও বোধ হয় ঠিক তেমন সেবা হইতেছে না, তাই আমি বলি আর দেরি না করিয়া ঠাকুরুনিদিদিকে আনানো যাক ৷” শৈলেন যতই ঢাকিয়া বলুক, একটা প্ৰকাণ্ড ভয় আসিয়া ভবানীচরণের মনকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। তাহার হাত-পা থারথার করিয়া কঁাপিতে লাগিল। তিনি বলিলেন, “তোমরা যেমন ভালো বোকা তাই করো ।” রাসমণির কাছে চিঠি গেল ; তিনি তাড়াতাড়ি বগলাচরণকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় আসিলেন । সন্ধ্যার সময় কলিকাতায় পৌঁছিয়া তিনি কেবল কয়েক ঘণ্টা মাত্ৰ কালীপদকে জীবিত দেখিয়াছিলেন । বিকারের অবস্থায় সে রহিয়া রহিয়া মাকে ডাকিয়াছিল- সেই ধ্বনিগুলি তাহার বুকে বিধিয়া রহিল । ভবানীচরণ এই আঘাত সহিয়া যে কেমন করিয়া বাচিয়া থাকিবেন সেই ভয়ে রাসমণি নিজের শোককে ভালো করিয়া প্ৰকাশ করিবার আর অবসর পাইলেন না- তাহার পুত্র আবার তাহার স্বামীর মধ্যে গিয়া বিলীন হইল- স্বামীর মধ্যে আবার দুজনেরই ভার তাহার ব্যথিত হৃদয়ের উপর তিনি তুলিয়া লইলেন। তাহার প্রাণ বলিল, আর আমার সয় না। তবু তাহাকে সহিতেই হইল। রাত্রি তখন অনেক । গভীর শোকের একান্ত ক্লান্তিতে কেবল ক্ষণকালের জন্য রাসমণি অচেতন হইয়া ঘুমাইয়া পডিয়ছিলেন । কিন্তু ভবানীচরণের ঘুম হইতেছিল না। কিছুক্ষণ বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করিয়া অবশেষে দীর্ঘনিশ্বাস-সহকারে ‘দয়াময় হরি' বলিয়া উঠিয়া পড়িয়াছেন । কালীপদ যখন গ্রামের বিদ্যালয়েই পড়িত, যখন সে কলিকাতায় যায় নাই, তখন সে যে-একটি কোণের ঘরে বসিয়া পড়াশুনা করিত ভবানীচরণ কম্পিত হন্তে একটি প্ৰদীপ ধরিয়া সেই শূন্যঘরে প্রবেশ করিলেন । রাসমণির হাতে চিত্র করা ছিন্ন কথাটি এখনো তক্তাপোশের উপর পাতা আছে, তাহার নানা স্থানে এখনো সেই কালির দাগ রহিয়াছে ; মলিন দেয়ালের গায়ে কয়লায় আঁকা সেই জ্যামিতির রেখাগুলি দেখা যাইতেছে ; তক্তাপোশের এক কোণে কতকগুলি হাতে-বাধা ময়লা কাগজের খাতার সঙ্গে তৃতীয় খণ্ড রয়াল রীডারের ছিন্নাবশেষ আজিও পড়িয়া আছে । আর-হায় হায়- তার ছেলেবিয়সের ছোটাে পায়ের একপাটি চটি যে ঘরের কোণে পড়িয়া ছিল তাহা এতদিন কেহ দেখিয়াও দেখে নাই, আজ তাহা সকলের চেয়ে বড়ো হইয়া চোখে দেখা দিলে- জগতে এমন কোনো মহৎ সামগ্ৰী নাই যাহা আজি ঐ। ছোটাে জুতাটিকে আড়াল করিয়া রাখিতে পারে । কুলুঙ্গিতে প্ৰদীপটি রাখিয়া ভবানীচরণ সেই তক্তাপোশের উপর আসিয়া বসিলেন । তাহার শুষ্ক চোখে জল আসিল না, কিন্তু তাহার বুকের মধ্যে কেমন করিতে লাগিল- যথেষ্ট পরিমাণে নিশ্বাস লাইতে র্তাহার পাজরা যেন ফাটিয়া যাইতে চাহিল। ঘরের পূর্বদিকের দরজা খুলিয়া দিয়া গরাদে ধরিয়া তিনি বাহিরের দিকে চাহিলেন । অন্ধকার রাত্রি, টিপ টপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। সম্মুখে প্রাচীরবেষ্টিত ঘন জঙ্গল। তাহার মধ্যে ঠিক পড়িবার ঘরের সামনে একটুখানি জমিতে কালীপদ বাগান করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছিল। এখনো তাহার স্বহন্তে রোপিত কুমকালত কফির বেড়ার উপর প্রচুর পল্লব বিস্তার করিয়া সজীব আছে- তাহ ফুলে ফুলে ভরিয়া গিয়াছে। আজ সেই বালকের যত্নলালিত বাগানের দিকে চাহিয়া তাহার প্রাণ যেন কাঠের কাছে উঠিয়া আসিল । আর কিছু আশা করিবার নাই ; গ্ৰীষ্মের সময় পূজার সময় কলেজের দুটি হয়, কিণ্ড যাহার জন্য ঠাহীর দরিদ্র ঘর শূন্য হইয়া আছে সে আর কোনোদিন কোনো দুটিতেই ঘরে ফিরিয়া আসিবে