পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

or রবীন্দ্র-রচনাবলী পাণরক্ষা S বংশীবদন তাহার ভাই রসিককে যেমন ভালোবাসিত এমন করিয়া সচারচর মাও ছেলেকে ভালোবাসিতে পারে না । পাঠশালা হইতে রসিকের আসিতে যদি কিছু বিলম্ব হইত। তবে সকল কাজ ফেলিয়া সে তাহার সন্ধানে ছুটিত । তাহাকে না খাওয়াইয়া সে নিজে খাইতে পারিত না। রসিকের অল্প কিছু অসুখবিসুখ হইলেই বংশীর দুই চােখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল ঝরিতে থাকিত । রসিক বংশীর চেয়ে ষোলো বছরের ছোটো । মাঝে যে কয়টি ভাইবোন জন্মিয়াছিল সবগুলিই মারা গিয়াছে। কেবল এই সব-শেষেরটিকে রাখিয়া, যখন রসিকের এক বছর বয়স, তখন তাহার মা মারা গেল এবং রসিক যখন তিন বছরের ছেলে তখন সে পিতৃহীন হইল। এখন রসিককে মানুষ করিবার ভার একা এই বংশীর উপর । তাতে কাপড় বোনাই বংশীর পৈতৃক ব্যবসায় । এই ব্যাবসা করিয়াই বংশীর বৃদ্ধ প্রপিতামহ অভিরাম বসাক গ্রামে যে দেবালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছে আজও সেখানে রাধানাথের বিগ্রহ স্থাপিত আছে । কিন্তু সমুদ্রপার হইতে এক কল-দৈত্য আসিয়া বেচারা তাতের উপর অগ্নিবাণ হানিল এবং তাতির ঘরে ক্ষুধাসুরকে বসাইয়া দিয়া ব্যাম্পযুৎকারে মুহুর্মুহু জয়শৃঙ্গ বাজাইতে লাগিল । তবু তাতের কঠিন প্ৰাণ মরিতে চায় না- ঠিকঠাক ঠকঠাক করিয়া সূতা দাঁতে লইয়া মাকু এখনো চলাচল করিতেছে- কিন্তু তাহার সাবেক চালচলন চঞ্চলা লক্ষ্মীর মনঃপূত হইতেছে না, লোহার দৈত্যটা কলে-বলে-কৌশলে তাহাকে একেবারে বশ করিয়া লইয়াছে । বংশীর একটু সুবিধা ছিল । থানাগড়ের বাবুরা তাহার মুরুব্বি ছিলেন । তাহদের বৃহৎ পরিবারের সমুদয় শৌখিন কাপড় বংশীই বুনিয়া দিত | একলা সব পারিয়া উঠিত না, সেজন্য তাহাকে লোক যদিচ তাহদের সমাজে মেয়ের দর বড়ো বেশি তবু চেষ্টা করিলে বংশী, এতদিনে যেমন-তেমন একটা বউ ঘরে আনিতে পারিত । রসিকের জন্যই সে আর ঘটিয়া উঠিল না। পূজার সময় কলিকাতা হইতে রসিকের যে সাজ আমদানি হইত। তাহা যাত্রার দলের রাজপুত্রকেও লজ্জা দিতে পারিত । এইরূপ আর-আর সকল বিষয়েই রসিকের যাহা-কিছু প্রয়োজন ছিল না, তাহা জোগাইতে গিয়া বংশীকে নিজের সকল প্রয়োজনই খর্ব করিতে হইল । তবু বংশরক্ষা করিতে তো হইবে । তাহদের বিবাহযোগ্য ঘরের একটি মেয়েকে মনে মনে ঠিক করিয়া বংশী টাকা জমাইতে লাগিল । তিনশো টাকা পণ এবং অলংকার-বাবদ আর একশো টাকা হইলেই মেয়েটিকে পাওয়া যাইবে স্থির করিয়া অল্প-অল্প কিছু-কিছু সে খরচ বঁাচাইয়া চলিল । হাতে যথেষ্ট টাকা ছিল না বটে, কিন্তু যথেষ্ট সময় ছিল । কারণ মেয়েটির বয়স সবে চার- এখনো অন্তত চার-পাচ বছর মেয়াদ পাওয়া যাইতে পারে । কিন্তু কোষ্ঠীতে তাহার সঞ্চায়ের স্থানে দৃষ্টি ছিল রসিকের । সে দৃষ্টি শুভগ্রহের দৃষ্টি নহে। রসিক ছিল তাঁহাদের পাড়ার ছোটাে ছেলে এবং সমবয়সীদের দলের সর্দার । যে লোক সুখে মানুষ হয় এবং যাহা চায় তাহাই পাইয়া থাকে ভাগ্যদেবতা-কর্তৃক বঞ্চিত হতভাগাদের পক্ষে তাহার ভারি একটা আকর্ষণ আছে । তাহার কাছে ঘোষিতে পাওয়াই যেন কতকটা পরিমাণে প্রার্থিত বস্তুকে পাওয়ার শামিল । যাহার অনেক আছে সে যে অনেক দেয় বলিয়াই লোকে তাহার কাছে আনাগোনা করে তাহা নহে- সে কিছু না দিলেও মানুষের লুব্ধ কল্পনাকে তৃপ্ত করে । শুধু যে রসিকের শৌখিনতাই পাড়ার ছেলেদের মন মুগ্ধ করিয়াছে। এ কথা বলিলে তাহার প্রতি অবিচার করা হইবে । সকল বিষয়েই রসিকের এমন একটি আশ্চর্য নৈপুণ্য ছিল যে তাহার চেয়ে উচ্চবংশের ছেলেরাও তাহাকে খাতির না করিয়া থাকিতে পারিত না । সে যাহাতে হাত দেয় তাহাই