পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

rive : Ο Σ. Σ তাহার গালে ঠাস করিয়া এক চড় বসাইয়া দিল। কখন তাহার কাছে রসিক পান চাহিবে বলিয়া সৌরভী যখন ঘাটের পাশে ঘাসের উপর দুই পা মেলিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে, এমন সময়ে রসিক হঠাৎ তাহাকে বলিল, “সৈরি, বড়ো ক্ষুধা পাইয়াছে, কিছু খাবার আনিয়া দিতে পারিস ?” সৌরভী খুশি হইয়া তাড়াতাড়ি দুটিয়া গিয়া বাড়ি হইতে আঁচল ভরিয়া মুড়িমুড়কি আনিয়া উপস্থিত করিল। রসিক সেদিন তাহার দাদার কাছেও ঘোষিল না । বংশীর শরীর মন খারাপ ছিল, রাত্রে সে তাহার ব্যাপকে স্বপ্ন দেখিল । স্বল্প হইতে উঠিয়া তাহার মন আরো বিকল হইয়া উঠিল । তাহার নিশ্চয় মনে হইল বংশলোপের আশঙ্কায় তাহার বাপের পরলোকেও ঘুম হইতেছে না । পরদিন বংশী কিছু জোর করিয়াই রসিককে কাজে বসাইয়া দিল। কেননা ইহা তো ব্যক্তিগত সুখদুঃখের কথা নহে, এ যে বংশের প্রতি কর্তব্য। রসিক কাজে বসিল বটে, কিন্তু তাহাতে কাজের সুবিধা হইল না ; তাহার হাত আর চলেই না, পদে পদে সুতা ছিড়িয়া যায়, সুতা সারিয়া তুলিতে তাহার বেলা কাটিতে থাকে । বংশী মনে করিল, ভালোরাপ অভ্যাস নাই বলিয়াই এমনটা ঘটিতেছে, কিছুদিন গেলেই হাত দুরন্ত হইয়া যাইবে । কিন্তু স্বভাবীপটি রসিকের হাত দুরন্ত হইবার দরকার ছিল না বলিয়াই তাহার হাত দুরন্ত হইতে চাহিল না। বিশেষত তাহার অনুগতবর্গ তাহার সন্ধানে আসিয়া যখন দেখিত সে নিতান্ত ভালোমানুষটির মতো তাহাদের বাপ-পিতামহের চিরকালীন ব্যবসায়ে লাগিয়া গেছে তখন রসিকের মনে ভারি লজা এবং রাগ হইতে লাগিল । দাদা তাহাকে তাহার এক বন্ধুর মুখ দিয়া খবর দিল যে, সীেরভীর সঙ্গেই রসিকের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করা যাইতেছে। বংশী মনে করিয়াছিল। এই সুখবরটায় নিশ্চয়ই রসিকের মন নরম হইবে । কিন্তু সেরাপ ফল তো দেখা গেল না । ‘দাদা মনে করিয়াছেন সীেরভীর সঙ্গে বিবাহ হইলেই আমার মোক্ষলাভ হইবে ?’ সৌরভীর প্রতি হঠাৎ তাহার ব্যবহারের এমনি পরিবর্তন হইল যে, সে বেচারা আঁচলের প্রান্তে পান বাধিয়া তাহার কাছে আসিতে আর সাহসই কারিত না- সমস্ত রকম-সকম দেখিয়া কী জানি এই ছোটো শান্ত মেয়েটির ভারি কান্না পাইতে লাগিল । হার্মেনিয়ম বাজনা সম্বন্ধে অনা মেয়েদের চেয়ে তাহার যে একটু বিশেষ অধিকার ঘটিয়াছিল, সে তো ঘুচিয়াই গেল— তার পর সর্বদাই রসিকের যে ফাইফরমাশ খাটিবার ভার তাহার উপর ছিল সেটাও রহিল না । হঠাৎ জীবনটা ফাকা এবং সংসারটা নিতান্তই ফাকি বলিয়া তাহার কাছে মনে হইতে লাগিল । এতদিন রসিক এই গ্রামের বনবাদােড়, রথীতলা, রাধানাথের মন্দির, নদী, খেয়াঘাট, বিল, দিঘি, কামারপাড়া, ছুতারপাড়া, হাটবাজার সমস্তই আপনার আনন্দে ও প্রয়োজনে বিচিত্ৰভাবে অধিকার করিয়া লইয়াছিল। সব জায়গাতেই তাহার একটা একটা আডা ছিল, যেদিন যেখানে খুশি কখনো-বা একলা কখনো-বা দলবলে কিছু-না-কিছু লইয়া থাকিত । এই গ্রাম এবং থানাগড়ের বাবুদের বাড়ি ছাড়া জগতের আর যে কোনো অংশ তাহার জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় তাহা সে কোনোদিন মনেও করে নাই। আজ এই গ্রামে তাহার মন আর কুলাইল না। দূর দূর বহুদূরের জন্য তাহার চিত্ত ছটফট করিতে লাগিল। তাহার অবসর যথেষ্ট ছিল- বংশী তাহাকে খুব বেশিক্ষণ কাজ করাইত না । কিন্তু ঐ একটুক্ষণ কাজ করিয়াই তাহার সমন্ত অবসর পর্যন্ত যেন বিস্বাদ হইয়া গেল ; এরাপ খণ্ডিত অবসরকে কোনো ব্যবহারে লাগাইতে তাহার ভালো লাগিল না । V) এই সময়ে থানাগড়ের বাবুদের এক ছেলে এক বাইসিকল কিনিয়া আনিয়া চড়া অভ্যাস করিতেছিল । রসিক সেটাকে লইয়া অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই এমন আয়ত্ত করিয়া লইল্প যেন সে তাহার নিজেরই পায়ের তলাকার একটা ডানা । কিন্তু কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ ! দূরত্বের সমন্ত