পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ (SO উঠিল । মুখে তাহার যাহা আসিল তাঁহাই বলিল । রসিক উদ্ধত হইয়া জবাব করিল, “তোমার অন্নে যদি আমি ভাগ বসাই। তবে আমি” ইত্যাদি ইত্যাদি । বংশী কহিল, “আর মিথ্যা বড়াই করিয়া কাজ নাই, তোমার সামর্থ্য যতদূর ঢের দেখিয়াছি ! শুধু বাবুদের নকলে বাজনা বাজাইয়া নবাবি করিলেই তো হয় না।” বলিয়া সে চলিয়া গেল- আর তাতে বসিতে পারিল না ; ঘরে মাদুরে গিয়া শুইয়া পড়িল । রসিক যে হার্মেনিয়ম বাজাইয়া চিত্তবিনোদন করিবার জন্য সঙ্গী জুটাইয়া আনিয়াছিল তাহা নহে। থানাগড়ে যে সার্কাসের দল আসিয়াছিল রসিক সেই দলে চাকরির উমেদারি করিতে গিয়াছিল । সেই দলেরই একজনের কাছে নিজের ক্ষমতার পরিচয় দিবার জন্য তাহকে যতগুলি গৎ জানে একে একে শুনাইতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিল- এমন সময় সংগীতের মাঝখানে নিতান্ত অন্যরকম সুর আসিয়া পীে ছিল। আজ পর্যন্ত বংশীর মুখ দিয়া এমন কঠিন কথা কখনো বাহির হয় নাই। নিজের বাক্যে সে নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। তাহার মনে হইল যেন তাহাকে অবলম্বন করিয়া আর-একজন কে এই নিষ্ঠুর কথাগুলো বলিয়া গেল । এমনতরো মর্মান্তিক ভৎসনার পরে বংশীর পক্ষে আর তাহার সঞ্চায়ের টাকা রক্ষা করা সম্ভবপর নহে । যে টাকার জন্য হঠাৎ এমন অভাবনীয় কাশুটা ঘটিতে পারিল সেই টাকার উপর বংশীর ভারি একটা রাগ হইল- তাহাতে আর তাহার কোনো সুখ রহিল না। রসিক যে তাহার। কত আদরের সামগ্ৰী, এই কথা কেবলই তাহার মনের মধ্যে তোলপাড় করিতে লাগিল। যখন সে "দাদা" শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করিতে পারিত না, যখন তাহার দুরন্ত হস্ত হইতে ঠাতের সূতাগুলোকে রক্ষা করা এক বিষম ব্যাপার ছিল, যখন তাহার দাদা হাত বাড়াইবামাত্র সে অন্য-সকলের কোল হইতেই ঝাপাইয়া পড়িয়া সবেগে তাহার বুকের উপর আসিয়া পড়িত, এবং তাহার ঝাকড়া চুল ধরিয়া টানাটানি করিত, তাহার নাক ধরিয়া দন্তহীন মুখের মধ্যে পুরিবার চেষ্টা করিত, সে-সমস্তই সুস্পষ্ট মনে পড়িয়া বংশীর প্রাণের ভিতরটাতে হাহা করিতে লাগিল । সে আর শুইয়া থাকিতে পারিল না । রসিকের নাম ধরিয়া বার-কয়েক করুণকণ্ঠে ডাকিল । সাড়া না পাইয়া তাহার জ্বর লইয়াই সে উঠিল । গিয়া দেখিল, সেই হার্মেনিয়মটা পাশে পড়িয়া আছে, অন্ধকারে দাওয়ায় রসিক চুপ করিয়া একলা বসিয়া । তখন বংশী কোমর হইতে সাপের মতো সরু লম্বা এক থলি খুলিয়া ফেলিল ; রুদ্ধপ্ৰায়কণ্ঠে কহিল, “এই নে ভাই- আমার এ টাকা সমন্ত তোরই জন্য । তোরই বউ ঘরে আনিব বলিয়া আমি এ জমাইতেছিলাম । কিন্তু তোকে কাদাইয়া আমি জমাইতে পারিব না, ভাই আমার, গোপাল আমারআমার সে শক্তি নাই- তুই চাকার গাড়ি কিনিস, তোর যা খুশি তাই করিস।” রসিক দাড়াইয়া উঠিয়া শপথ করিয়া কঠোরস্বরে কহিল, "চাকার গাড়ি কিনিতে হয়, বউ আনিতে হয়, আমার নিজের টাকায় করিব- তোমার ও টাকা আমি দুইব না।” বলিয়া বংশীর উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল । উভয়ের মধ্যে আর এই টাকার কথা বলার পথ রহিল না- কোনো কথা বলাই অসম্ভব হইয়া উঠিল । 8 রসিকের ভক্তশ্রেষ্ঠ গোপাল আজকাল অভিমান করিয়া দূরে দূরে থাকে। রসিকের সামনে দিয়া তাহাকে দেখাইয়া দেখাইয়া একাই মাছ ধরিতে যায়, আগেকার মতো তাহাকে ডাকাডাকি করে না। আর, সৌরভীর তো কথাই নাই। রসিকদাদার সঙ্গে তাহার আড়ি, একেবারে জন্মের মতো আড়িঅথচ সে যে এতবড়ো একটা ভয়ংকর আড়ি করিয়াছে, সেটা রসিককে স্পষ্ট করিয়া জানাইবার সুযোগ না পাইয়া, আপনার মনে ঘরের কোণে অভিমানে ক্ষণে ক্ষণে কেবলই তাহার দুই চোখ ভরিয়া উঠিতে লাগিল । এমন সময়ে একদিন রসিক মধ্যাহ্নে গোপালদের বাড়িতে গিয়া তাহাকে ডাক দিল । আদর করিয়া তাহার কান মলিয়া দিল, তাহাকে কাতুকুতু দিতে লাগিল। গোপাল প্রথমটা প্রবল আপত্তি প্ৰকাশ করিয়া লড়াইয়ের ভাব দেখাইল, কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা রাখিতে পারিল না ; দুইজনে বেশ হাস্যালাপ জমিয়া উঠিল । রসিক কহিল, “গোপাল, আমার হার্মেনিয়মটি নিবি ?”