পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@ ՏԳ সুবোধ তো লাফাইয়া উঠিল- বলিল, “তুমি তাতি ! আমি তো ঠাতি খুজিতেই বাহির হইয়াছি। আজকাল তাহদের দর এত বাডিয়াছে যে, কেহই আমাদের তাতের স্কুলে শিক্ষকতা করিতে যাইতে ट्राछि झझ •ा ।” রসিক ঠাতের স্কুলের শিক্ষক হইয়া কলিকাতায় আসিল । এতদিন পরে বাসা খরচ বাদে সে সামান্য কিছু জমাইতে পারিল, কিন্তু বাইসিকল-চক্রের লক্ষ্য ভেদ করিতে এখনো অনেক বিলম্ব আছে। আর বধুর বরমাল্যের তো কথাই নাই। ইতিমধ্যে তাতের স্কুলটা গোড়ায় যেমন হঠাৎ জ্বলিয়া উঠিয়ছিল তেমনি হঠাৎ নিবিয়া যাইবার উপক্রম হইল। কমিটির বাবুরা যতক্ষণ কমিটি করিতে থাকেন অতি চমৎকার হয়, কিন্তু কাজ করিতে নামিলেই গণ্ডগোল বাধে । তঁহারা নানা দিগদেশ হইতে নানা প্রকারের ষ্ঠাত আনাইয়া শেষকালে এমন একটা অপরাপ জঞ্জাল বুনিয়া তুলিলেন যে সমস্ত ব্যাপারটা লইয়া যে কোন আবর্জনাকুণ্ডে ফেলা যাইতে পারে তাহা কমিটির পর কমিটি করিয়াও স্থির করিতে •द्विष्ट्न् न् । রসিকের আর সহ্য হয় না। ঘরে ফিরিবার জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। চোখের সামনে সে কেবলই আপনার গ্রামের নানা ছবি দেখিতেছে । অতি তুচ্ছ খুঁটিনাটিও উজ্জ্বল হইয়া তাহার মনের সামনে দেখা দিয়া যাইতেছে । পুরোহিতের আধপাগলা ছেলেটা ; তাহদের প্রতিবেশীর কপিলবর্ণের বাছুরটা ; নদীর পথে যাইতে রাস্তার দক্ষিণ ধারে একটা তালগাছকে শিকড় দিয়া আঁটিয়া জড়াইয়া একটা অশথগাছ দুই কুস্তিগির পালোয়ানের মতো প্যাচ কবিয়া দাড়াইয়া আছে ; তাহারই তলায় একটা অনেকদিনের পরিত্যক্ত ভিটা ; তাহদের বিলের তিন দিকে আমন ধান, এক পাশে গভীর জলের প্রান্তে মাছধরা জাল বাধিবার জন্য বাশের খোটা পোতা, তাহারই উপরে একটি মাছরাঙা চুপ করিয়া বসিয়া ; কৈবর্তপাড়া হইতে সন্ধ্যার পরে মাঠ পার হইয়া কীর্তনের শব্দ আসিতেছে ; ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে নানাপ্রকার মিশ্রিত গন্ধে গ্রামের ছায়াময় পথে স্তব্ধ হওয়া ভরিয়া রহিয়াছে ; আর তারই সঙ্গে মিলিয়া তাহার সেই ভক্তবন্ধুর দল, সেই চঞ্চল গোপাল, সেই আঁচলের-খুটি-পান-বাধা বড়ো-বড়ো-সিন্ধা-চোখ-মেলা সৌরভী, এই-সমস্ত স্মৃতি ছবিতে গন্ধে শব্দে স্নেহে শ্ৰীতিতে বেদনায় তাহার মনকে প্রতিদিন গভীরতর আবিষ্ট কবিয়া ধরিতে লাগিল । গ্রামে থাকিতে রসিকের যে নানাপ্রকার কারুনৈপুণ্য প্রকাশ পাইত এখানে তাহা একেবারে বন্ধ হইয়া গেছে, এখানে তাহার কোনো মূল্য নাই ; এখানকার দোকান-বাজারের কলের তৈরি জিনিস হাতের চেষ্টাকে লজ্জা দিয়া নিরন্ত করে । তাতের ইস্কুলে কাজ কাজের বিড়ম্বনামাত্র, তাহাতে মন ভরে না । থিয়েটারের দীপশিখা তাহার চিত্তকে পতঙ্গের মতো মরণের পথে টানিয়াছিল- কেবল টাকা জমাইবার কঠোর নিষ্ঠা তাহাকে ধাচাইয়াছে । সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে কেবলমাত্র তাহার গ্রামটিতে যাইবার পথই তাহার কাছে একেবারে রুদ্ধ ! এইজন্যই গ্রামে যাইবার টান প্রতি মুহুর্তে তাহাকে এমন করিয়া পীড়া দিতেছে। তাতের ইস্কুলে সে প্রথমটা ভারি ভরসা পাইয়াছিল, কিন্তু আজ যখন সে আশা আর টেকে না, যখন তাহার দুই মাসের বেতনই সে আদায় করিতে পারিল না, তখন সে আপনাকে আর ধরিয়া রাখিতে পারে না। এমন হইল । সমস্ত লজ্জা স্বীকার করিয়া, মাথা হেঁট করিয়া, এই এক বৎসর প্রবাসবাসের বৃহৎ ব্যর্থতা বহিয়া দাদার আশ্রয়ে যাইবার জন্য তাহার মনের মধ্যে কেবলই তাগিদ আসিতে লাগিল । যখন মনটা অত্যন্ত যাই-যাই করিতেছে এমন সময় তাহার বাসার কাছে খুব ধুম করিয়া একটা বিবাহ হইল । সন্ধ্যাবেলায় বাজনা বাজাইয়া বর আসিল । সেইদিন রাত্রে রসিক স্বপ্ন দেখিল, তাহার মাথায় টোপর, গায়ে লাল চেলি, কিন্তু সে গ্রামের ইবাশঝাড়ের আড়ালে দাড়াইয়া আছে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা ‘তোর বর আসিয়াছে’ বলিয়া সৌরভীকে খেপাইতেছে, সৌরভীী বিরক্ত হইয়া কাদিয়া ফেলিয়াছে- রসিক তাহাদিগকে শাসন করিতে চুটিয়া আসিতে চায়, কিন্তু কেমন করিয়া কেবলই বাশের কঞ্চিতে তাহার কাপড় জড়াইয়া যায়, ডালে তাহার টোপর আটকায়, কোনোমতেই পঞ্চা করিয়া বাহির হইতে পারে না। জাগিয়া উঠিয়া রসিকের মনের মধ্যে ভারি লজ্জা বোধ হইতে লাগিল । বন্ধু তাহার জন্য ঠিক করা আছে। অথচ সেই বধূকে ঘিরে আনিবার যোগ্যতা তাহার নাই এইটেই তাহার