পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ο OO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বেশি আদায় করে নিতে হয় । অর্থাৎ আবেগকে প্রকাশ করতে গেলে কথার মধ্যে সেই আবেগের ধর্ম সঞ্চার করতে হয় । আবেগের ধর্ম হচ্ছে বেগ । কথা যখন সেই বেগ গ্ৰহণ করে তখনই আমাদের হৃদয়ভাবের সঙ্গে তার মিল ঘটে । এই বেগের কত বৈচিত্ৰ্যই যে আছে তার ঠিকানা নেই। এই বেগের বৈচিত্র্যেই তো আলোকের রঙ বদল হচ্ছে, শব্দের সুর বদল হচ্ছে, এবং লীলাময়ী সৃষ্টি রূপ থেকে রূপান্তর গ্রহণ করছে। এমন-কি, সৃষ্টির বাইরের পর্দা সরিয়ে ভিতরের রহস্যনিকেতনে যতই প্রবেশ করা যায় ততই বস্তুত্ব ঘুচে গিয়ে কেবল বেগই প্রকাশ পেতে থাকে । শেষকালে এই কথাই মনে হয়, প্রকাশবৈচিত্র্যের মূলে বুঝি এই বেগবৈচিত্ৰ্য । যদিদং সৰ্বং প্রাণ এজাতি নিঃসৃতম | মানুষের সত্তার মধ্যে এই অনুভূতিলোকই হচ্ছে সেই রহস্যলোক যেখানে বাহিরের রূপজগতের সমস্ত বেগ অন্তরে আবেগ হয়ে উঠছে, এবং সেই অন্তরের আবেগ আবার বাহিরে রূপ গ্ৰহণ করবার জন্যে উৎসুক হচ্ছে । এইজন্যে বাক্য যখন আমাদের অনুভূতিলোকের বাহনের কাজে ভর্তি হয় তখন তার গতি না হলে চলে না । সে তার অর্থের দ্বারা বাহিরের ঘটনাকে ব্যক্ত করে, গতির দ্বারা অন্তরের গতিকে প্ৰকাশ করে । শ্যামের নাম রাধা শুনেছে। ঘটনাটা শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু যে-একটা অদৃশ্য বেগ জন্মালো তার আর শেষ নেই । আসল ব্যাপারটাই হল তাই । সেইজনে কবি ছন্দের ঝংকারের মধ্যে এই কথাটাকে দুলিয়ে দিলেন । যতক্ষণ ছন্দ থাকবে ততক্ষণ এই দোলা আর থামবে না । ‘সই, কেবা শুনাইল শ্যামনাম । কেবলই ঢেউ উঠতে লাগল। ঐ কটি কথা ছাপার অক্ষরে যদিও ভালোমানুষের মতো দাড়িয়ে থাকার ভান করে, কিন্তু ওদের অন্তরের স্পন্দন আর কোনোদিনই শান্ত হবে না । ওরা অস্থির হয়েছে, এবং অস্থির করাই ওদের কাজ । আমাদের পুরাণে ছন্দের উৎপত্তির কথা যা বলেছে তা সবাই জানেন । দুটি পাখির মধ্যে একটিকে যখন ব্যাধ মারলে তখন বাল্মীকি মনে যে ব্যথা পেলেন সেই ব্যাথাকে শ্লোক দিয়ে না জানিয়ে তার উপায় ছিল না। যে পাখিটা মারা গেল এবং আর যে একটি পাখি তার জন্যে র্কাদল তারা কোনকালে লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই নিদারুণতার ব্যথাটিকে তো কেবল কালের মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায় না । সে-যে অনন্তের বুকে বেজে রইল। সেইজন্যে কবির শাপ ছন্দের বাহনকে নিয়ে কাল থেকে কালান্তরে ছুটিতে চাইলে । হায় রে, আজও সেই ব্যাধ নানা অস্ত্ৰ হাতে নানা বীভৎসতার মধ্যে নানা দেশে নানা আকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে । কিন্তু সেই আদিকবির শাপ শাশ্বতকালের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে রইল। এই শাশ্বতকালের কথাকে প্রকাশ করবার জন্যেই তো ছন্দ । আমরা ভাষায় বলে থাকি, কথাকে ছন্দে বাধা । কিন্তু এ কেবল বাইরে ধাধন, অন্তরে মুক্তি । কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যেই হিন্দ । সেতারের তার বাধা থাকে বটে। কিন্তু তার থেকে সুর পায় ছাড়া । ছন্দ হচ্ছে সেই তার-বাধা সেতার, কথার অন্তরের সুরকে সে ছাড়া দিতে থাকে । ধনুকের সে ছিলা, কথাকে। সে তীরের মতো লক্ষোর মর্মের মধ্যে প্ৰক্ষেপ করে । গোড়াতেই ছন্দ সম্বন্ধে এতখানি ওকালতি করা হয়তো বাহুল্য বলে অনেকের মনে হতে পারে । কিন্তু আমি জানি, এমন লোক আছেন যারা ছন্দকে সাহিত্যের একটা কৃত্রিম প্ৰথা বলে মনে করেন । তাই আমাকে এই গোড়ার কথাটা বুঝিয়ে বলতে হল যে পৃথিবী ঠিক চব্বিশ ঘণ্টার ঘূর্ণিলয়ে তিনশো। পয়ষটি মাত্রার ছন্দে সূর্যকে প্ৰদক্ষিণ করে, সেও যেমন কৃত্রিম নয়, ভাবাবেগ তেমনি ছন্দকে আশ্রয় করে আপন গতিকে প্রকাশ করবার যে চেষ্টা করে সেও তেমনি কৃত্রিম নয় । এইখানে কাব্যের সঙ্গে গানের তুলনা করে আলোচ্য বিষয়টাকে পরিষ্কার করবার চেষ্টা করা যাক । সুর পদার্থটাই একটা বেগ। সে আপনার মধ্যে আপনি স্পদিত হচ্ছে। কথা যেমন অর্থের মোক্তারি করবার জন্যে, সুর তেমন নয়, সে আপনাকে আপনিই প্রকাশ করে । বিশেষ সুরের সঙ্গে বিশেষ সুরের সংযোগে ধ্বনিবেগের একটা সমবায় উৎপন্ন হয় । তাল সেই সমবেত বেগটাকে গতিদান করে । ধ্বনির এই গতিবেগে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে যে গতি, সঞ্চার করে সে একটা বিশুদ্ধ আবেগ