পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ł8 R রবীন্দ্র-রচনাবলী ছন্দের হসন্ত হলন্ত’ আমার নিজের বিশ্বাস যে, আমরা ছন্দ রচনা করি স্বতই কানের ওজন রেখে, বাজারে প্রচলিত কোনো বাইরের মানদণ্ডের দ্বারা মেপে মেপে এ কাজ করি নে, অন্তত সজ্ঞানে নয় । কিন্তু ছান্দসিক প্ৰবোধচন্দ্ৰ সেন এই বলে আমাদের দোষ দিয়েছেন যে- আমরা একটা কৃত্রিম মানদণ্ড দিয়ে, পাঠকের কানকে ফাকি দিয়ে, তার চোখ ভুলিয়ে এসেছি ; আমরা ধ্বনি চুরি করে থাকি অক্ষরের আড়ালে । ছন্দোবিৎ কী বলছেন ভালো করে বোঝবার চেষ্টা করা যাক । তার প্রবন্ধে আমার লেখা থেকে কিছু লাইন তুলে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তস্বরূপে ব্যবহার করেছেন। যথা— -- + 1 গন্তে ঐ শুভ্ৰ শৰ বাজে । 十 মোর চিত্ত মাঝে, , -- চিরনূতনেরে দিল ডাক | 十 *চিশে বৈশাখ । তিনি বলেন, “এখানে দণ্ডচিহ্নিত যুগ্মধ্বনিগুলিকে এক বলে ধরা হয়েছে, কারণ এগুলি শব্দের মধ্যে অবস্থিত ; আর যোগচিহ্নিত যুগ্মধ্বনিগুলিকে দুই বলে ধরা হয়েছে, যেহেতু এগুলি শব্দের অন্তে অবস্থিত ।” অর্থাৎ “উদয়'-এর আয় হয়েছে দুই মাত্রা অথচ দিগন্ত’-এর অন হয়েছে এক মাত্রা, এইজনো ‘উদয় শব্দকেও তিন মাত্রা এবং ‘দিগন্ত’ শব্দকেও তিন মাত্রা গণনা করা হয়েছে। “যুষ্মধ্বনি' শব্দটার পরিবর্তে ইংরেজি সিলেবল শব্দ ব্যবহার করলে অনেকের পক্ষে সহজ হবে । আমি তাই করব । বহুকাল পূর্বে একদিন বাংলার শব্দতত্ত্ব আলোচনা করেছিলাম। সেই প্রসঙ্গে ধ্বনিতত্ত্বের কথাও মনে উঠেছিল । তখন দেখেছিলুম, বাংলায় স্বরবর্ণ যদিও সংস্কৃত বানানের হ্রস্বদীর্ঘতা মানে না। তবু এ সম্বন্ধে তার নিজের একটি স্বকীয় নিয়ম আছে। সে হচ্ছে বাংলায় হসন্তু শব্দের পূর্ববতী স্বর দীর্ঘ হয় । যেমন জল, চাদ । এ দুটি শব্দের উচ্চারণে জ-এর অ এবং চা-এর আ আমরা দীর্ঘ করে টেনে পরবতী হসন্তের ক্ষতিপূরণ করে থাকি । জল এবং জলা, চাদ এবং চান্দা শব্দের তুলনা করলে এ কথা ধরা পড়বে । এ সম্বন্ধে বাংলার বিখ্যাত ধ্বনিতত্ত্ববিৎ সুনীতিকুমারের বিধান নিলে নিশ্চয়ই তিনি আমার সমর্থন করবেন । বাংলায় ধ্বনির এই নিয়ম স্বাভাবিক বলেই আধুনিক বাঙালি কবি ও ততোধিক আধুনিক বাঙালি ছন্দোবিৎ জন্মাবার বহু পূর্বেই বাংলা ছন্দে প্রাকহসন্ত স্বরকে দুই মাত্রার পদবি দেওয়া হয়েছে । আজ পর্যন্ত কোনো বাঙালির কানে ঠেকে নি ; এই প্ৰথম দেখা গেল, নিয়মের ধাধায় পড়ে বাঙালি পাঠক কানকে অবিশ্বাস করলেন । কবিতা লেখা শুরু করবার বহুপূর্বে সবে যখন দাত উঠেছে তখন পড়েছি, “জলি পড়ে, পাতা নড়ে ।” এখানে 'জল' যে ‘পাতার চেয়ে মাত্রাকীেলীন্যে কোনো অংশে কম, এমন সংশয় কোনো বাঙালি শিশু বা তার পিতামাতার কানে বা মনেও উদয় হয় নি । এইজন্যে ঐ দুটাে কথা অনায়াসে এক পঙক্তিতে বসে গেছে, আইনের ঠেলা খায় নি। ইংরেজি মতে জল সর্বত্রই এক সিলেবল, “পাতা তার ডবল ভারী । কিন্তু জল শব্দটা ইংরেজি নয়। “কাশীরাম নামের “কাশী’ এবং ‘রাম যে একই ওজনের এ কথাটা কাশীরামের স্বজাতীয় সকলকেই মানতেই হয়েছে। “উদয়দিগন্তে ঐ শুভ্ৰ শঙ্খ বাজে৷” এই লাইনটা নিয়ে আজ পর্যন্ত প্ৰবোধচন্দ্র ছাড়া আর কোনো ১ “হলন্ত শব্দটি কবি- কর্তৃক স্বরান্ত অর্থে ব্যবহৃত ।