পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G? VO রবীন্দ্র-রচনাবলী সংস্কৃত ভাষায় নূতন ছন্দ বানানো সহজ নয়, পুরানাে ছন্দ রক্ষা করাও কঠিন। যথানিয়মে দীর্ঘত্ব স্বরের পর্যায় বেঁধে তার সংগীত । বাংলায় সেই দীর্ঘধিবনিগুলিকে দুইমাত্রায় বিশ্লিষ্ট করে একটা ছন্দ দাড় করানো যেতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে মূলের মর্যাদা থাকবে না । মন্দাক্রান্তার বাংলা রূপান্তর দেখলেই তা বোঝা যাবে । যক্ষ সে কোনো জনা আছিল আনমনা, সেবার অপরাধে প্ৰভুশাপে হয়েছে বিলয়গত মহিমা ছিল যত, বরষাকাল যাপে দুখতাপে । নির্জন রামগিরি শিখরে মরে ফিরি একাকী দূরবাসী প্রিয়াহারা যেথায় শীতল ছায় ঝরনা বহি যায় সীতার মানপূত জলধারা । মাস পরে কাটে মাস, প্রবাসে করে বাস প্ৰেয়সীবিচ্ছেদে রিমলিন ; কনকবলয়-খাসা বাহুর ক্ষীণ দশা, বিরহাদুখে হল বলহীন । একদা আষাঢ় মাসে প্রথম দিন আসে, যক্ষ নিরাখিল গিরিপর ঘনঘোর মেঘ এসে লেগেছে সানুদেশে, দন্ত হানে যেন করিবার । काठिंक S००> ܔ উপরের প্রবন্ধে লিখেছি “তঁমাধার রজনী পোহালো’ গানটি নয় মাত্রার ছন্দে রচিত । ছন্দতত্ত্বে প্রবীণ অমূল্যবাবু ওর নয়-মাত্রিকতার দাবি একেবারে নামজুর করে দিলেন । আর কারো হাত থেকে এ রায় এলে তাকে আপিল করবার যোগ্য বলেও গণ্য করতুম না, এ ক্ষেত্রে ধাধা লাগিয়ে দিলে । রাস্তার লোক এসে যদি আমাকে বলে তোমার হাতে পাচটা আঙুল নেই, তা হলে মনে উদবেগের কোনো কারণ ঘটে না । কিন্তু, শারীরতত্ত্ববিদ এসে যদি এই সংবাদটা জানিয়ে যান তা হলে দশবার করে নিজের আঙুল গুনে দেখি, মনে ভয় হয়, অঙ্ক বুঝি ভুলে গেছি। অবশেষে নিতান্ত হতাশ হয়ে স্থির করি, যে-কটাকে এতদিন আঙুল বলে নিশ্চিন্ত ছিলুম বৈজ্ঞানিক মতে তার সাব-কটা আঙুলিই নয় ; হয়তো শাস্ত্ৰবিচারে জানা যাবে যে, আমার আঙুল আছে মাত্র তিনটি, বাকি দুটাে বুড়ো আঙুল আর কড়ে আঙুল, তারা হরিজন-শ্ৰেণীয় । বর্তমান তর্কে আমার মনে সেইরকম উদবেগ জন্মেছে । “আঁধার রজনী পোকালো চরণের মাত্ৰাসংখ্যা যে দিক থেকে যেমন করে গানে দেখি, নয়। মাত্রায় গিয়ে ঠেকে । অমূল্যবাবু বললেন, এটা তো নয় মাত্রার ছন্দ নয়ই, বাংলা ভাষায় আজও নয় মাত্রার উদ্ভব হয় নি, হয়তো নিরবধিকালে কোনো এক সময়ে হতেও পারে । তিনি বলেন, বাংলা ছন্দ দশ মাত্রাকে মেনেছে, নয় মাত্রাকে মানে নি । এ কথায় আরো আমার ধাধা লাগিল । অমূল্যবাবু পরীক্ষা করে বলছেন, এ ছন্দে জোড়ের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । “আঁধার রজনী' পর্যন্ত এক পর্ব, এইখানে একটা ফাক ; তার পরে ‘পোহালো’ শব্দে তিন মাত্রার একটা পঙ্গু পৰ্ব্বাঙ্গ ; তার পরে পুরো যতি । অর্থাৎ, এ ছন্দে ছয় মাত্রারই প্রাধান্য । এর ধড়টা ছয় মাত্রার, ল্যােজটা তিন মাত্রার । চোখ দিয়ে এক পঙক্তিতে নয় মাত্রা দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু অমূল্যবাবুর মতে, কান দিয়ে দেখলে ওরা দুটাে অসমান ভাগ বেরিয়ে পড়ে । এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমার অঙ্কবিদ্যায় আমি যে সংখ্যাকে ৯ বলি অমূল্যবাবুর অঙ্কশাস্ত্রেও তাকেই ৯ বলে বটে, কিন্তু ছন্দের মাত্ৰানির্ণয় সম্বন্ধে তার পদ্ধতির সঙ্গে আমার পদ্ধতির মূলেই প্রভেদ আছে ! কথাটা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো । পৃথিবী চলছে, তার একটা ছন্দ আছে । অর্থাৎ, তার গতিকে মাত্ৰাসংখ্যায় ভাগ করা যায় । এই ছন্দের পূর্ণায়তনকে নির্ণয় করব কোন লক্ষণ মতে । পৃথিবী নিয়মিত কালে সূর্যকে প্ৰদক্ষিণ করে ।