পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ರಾ? G? Ved শিল্পই দেবশিল্পের স্তবগান করছে। এতেষাং বৈ শিল্পানামানুকৃতীহ শিল্পম অধিগম্যতে । মানবলোকের সব শিল্পই এই দেবশিল্পের অনুকৃতি, অর্থাৎ বিশ্বশিল্পের রহস্যকেই অনুসরণ করে মানবশিল্প । সেই মূল রহস্য ছন্দে, সেই রহস্য আলোকতরঙ্গে, শব্দতরঙ্গে, রক্ততরঙ্গে, স্নায়ুতন্তুর বৈদ্যুততরঙ্গে । মানুষ তার প্রথম ছন্দের সৃষ্টিকে জাগিয়েছে আপনি দেহে । কেননা তার দেহ ছন্দরচনার উপযোগী । ভূতলের টান থেকে মুক্ত করে দেহকে সে তুলেছে উর্ধর্ব দিকে । চলমান মানুষের পদে পদে ভারসাম্যের অপ্রতিষ্ঠাতা, unstable equilibrium । এতেই তার বিপদ, এতেই তার সম্পদ । চলার চেয়ে পড়াই তার পক্ষে সহজ । ছাগলের ছানা চলা নিয়েই জন্মেছে, মানুষের শিশু চলাকে আপনি সৃষ্টি করেছে ছন্দে । সামনে-পিছনে ডাইনে-ধায়ে পায়ে-পায়ে দেহভারকে মাত্রাবিভক্ত করে ওজন বাচিয়ে তবেই তার চলা সম্ভব হয় । সেটা সহজ নয়, মানবশিশুর চলার ছন্দসাধনা দেখলেই তা বোঝা যায় । যে পর্যন্ত আপনি ছন্দকে সে আপনি উদ্ভাবন না করে সে পর্যন্ত তার হামাগুড়ি, অর্থাৎ, ভারাকর্ষণের কাছে তার অবনতি, সে পর্যন্ত সে নৃত্যুহীন । - চতুষ্পদ জন্তুর নিত্যই হামাগুড়ি । তার চলা মাটির কাছে হার মেনে চলা । লাফ দিয়ে যদি-বা সে উপরে ওঠে, পরীক্ষণেই মাটির দরবারে ফিরে এসেই তার মাথা হেঁট । বিদ্রোহী মানুষ মাটির একান্ত শাসন থেকে দেহভারকে মুক্ত করে নিয়ে তাতেই চালায় প্রয়োজনের কাজ এবং অপ্রয়োজনের লীলা । ভূমির টানের বিরুদ্ধে ছন্দের সাহায্যে তার এই জয়লব্ধ শক্তি । ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ বলছেন : আত্মসংস্কৃতির্বােব শিল্পানি । শিল্পই হচ্ছে আত্মসংস্কৃতি । সম্যক রূপদানই সংস্কৃতি, তাকেই বলে শিল্প । আত্মাকে সুসংযত করে মানুষ যখন আত্মার সংস্কার করে, অর্থাৎ তাকে দেয় সম্যক রূপ, সেও তো শিল্প। মানুষের শিল্পের উপাদান কেবল তো কাঠ্যপাথর নয়, মানুষ নিজে । বর্বর অবস্থা থেকে মানুষ নিজেকে সংস্কৃত করেছে। এই সংস্কৃতি তার স্বরচিত বিশেষ ছন্দোময় শিল্প । এই শিল্প নানা দেশে, নানা কালে, নানা সভ্যতায়, নানা আকারে প্রকাশিত, কেননা বিচিত্র তার ছন্দ । ছন্দোময়ং বা ঐতৈর্যাজমান আত্মানং সংস্কুরুতে। শিল্পযজ্ঞের যজমােন আত্মাকে সংস্কৃত করেন, তাকে করেন ছন্দোময় । যেমন মানুষের আত্মার তেমনি মানুষের সমাজেরও প্রয়োজন ছন্দোময় সংস্কৃতি । সমাজও শিল্প । সমাজে আছে নানা মত, নানা ধর্ম, নানা শ্রেণী । সমাজের অন্তরে সৃষ্টিতত্ত্ব যদি সক্রিয় থাকে, তা হলে সে এমন ছন্দ উদ্ভাবন করে যাতে তার অংশ-প্ৰত্যংশের মধ্যে কোথাও ওজনের অত্যন্ত বেশি অসাম্য না হয় । অনেক সমাজ পঙ্গু হয়ে আছে ছন্দের এই ক্রটিতে, অনেক সমাজ মরেছে ছন্দের এই অপরাধে । সমাজে যখন হঠাৎ কোনো একটা সংরাগ অতিপ্রবল হয়ে ওঠে তখন মাতাল সমাজ পা ঠিক রাখতে পারে না, ছন্দ থেকে হয়। ভ্ৰষ্ট । কিংবা যখন এমন সকল মতের, বিশ্বাসের, ব্যবহারের বোঝা অচল হয়ে কাধে চেপে থাকে, যাকে ছন্দ বাচিয়ে সম্মুখে বহন করে চলা সমাজের পক্ষে অসম্ভব হয়, তখন সেই সমাজের পরাভব ঘটে । যেহেতু জগতের ধর্মই চলা, সংসারের ধর্ম স্বভাবতই সরতে থাকা, সেইজন্যেই তার বাহন ছন্দ । যে গতি ছন্দ রাখে না, তাকেই বলে দুৰ্গতি । মানুষের ছন্দোময় দেহ কেবল প্ৰাণের আন্দোলনকে নয়। তার ভাবের আন্দোলনকেও যেমন সাড়া দেয়, এমন আর কোনো জীবে দেখি নে । অন্য জন্তর দেহেও ভাবের ভাষা আছে কিন্তু মানুষের দেহভঙ্গির মতো সে ভাষা চিন্ময়তা লাভ করে নি, তাই তার তেমন শক্তি নেই, ব্যাজনা নেই। কিন্তু, এই যথেষ্ট নয়। মানুষ সৃষ্টিকর্তা । সৃষ্টি করতে গেলে ব্যক্তিগত তথ্যকে দাড় করাতে হয় বিশ্বাগত সত্যে । সুখদুঃখ-রাগবিরাগের অভিজ্ঞতাকে আপনি ব্যক্তিগত ঐকান্তিকতা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেটাকে রূপসৃষ্টির উপাদান করতে চায় মানুষ । “আমি ভালোবাসি’। এই কথাটিকে ব্যক্তিগত ভাষায় প্ৰকাশ করা যেতে পারে ব্যক্তিগত সংবাদ বহন করবার কাজে । আবার, “আমি ভালোবাসি’। এই কথাটিকে “আমি থেকে স্বতন্ত্র করে সৃষ্টির কাজে লাগানো যেতে পারে, যে সৃষ্টি সর্বজনের, সৰ্বকালের । যেমন সাজাহানের বিরহশোক দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তাজমহল, সাজাহানের সৃষ্টি অপরূপ ছন্দে অতিক্রম করেছে ব্যক্তিগত সাজাহানকে ।