পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ø ዓ \ኃ রবীন্দ্র-রচনাবলী গদ্যছন্দ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত কথা যখন খাড়া দাডিয়ে থাকে তখন সে কেবলমাত্র আপনি অর্থটুকু নিবেদন করে । যখন তাকে ছন্দের আঘাতে নাড়া দেওয়া যায়। তখন তার কাছ থেকে অর্থের বেশি আরো কিছু বেরিয়ে পড়ে । সেটা জানার জিনিস নয়, বেদনার জিনিস । সেটাতে পদার্থের পরিচয় নয়, মাসের সম্ভোগ । আবেগকে প্ৰকাশ করতে গেলে কথার মধ্যে আবেগের ধর্ম সঞ্চার করতে হয় । আবেগের ধর্ম হচ্ছে বেগ ; সে চলে, চালায় । কথা যখন সেই বেগ গ্রহণ করে তখন স্পন্দিত হৃদয়ভাবের সঙ্গে তার সাধর্ম ঘটে । চলতি ভাষায় আমরা বলি কথাকে ছন্দে বাধা । বাধা বটে, কিন্তু সে বাধন বাইরে, রূপের দিকে ; ভাবেব দিকে মুক্তি । যেমন সেতারে তার বাধা, তার থেকে সুর পায় ছাড়া । ছন্দ সেই সেতারের বাধা তার, সুরের বেগে কথাকে অন্তরে দেয় মুক্তি । উপনিষদে আছে, আত্মার লক্ষ্য ব্ৰহ্ম, ওস্তারের ধ্বনিবেগ তাকে ধনুর মতো লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেয় । এতে বলা হচ্ছে, বাক্যের দ্বারা যুক্তির দ্বারা ব্ৰহ্ম জানিবার বিষয় নন, তিনি আত্মার সঙ্গে একাত্ম হবার বিষয় । এই উপলব্ধিতে ধ্বনিই সহায়তা করে, শব্দার্থ করে না । জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় উভয়ের মধ্যে মোকাবিলা হয় মাত্র ; অর্থাৎ সান্নিধ্য হয়, সাযুজা হয় না । কিন্তু, এমন-সকল বিষয় আছে যাকে জানার দ্বারা পাওয়া যায় না, যাকে আত্মস্থ করতে হয় । আমি বস্তুটাকে সামনে রেখে জানা চলে, কিন্তু তার রসটাকে আত্মগত করতে না পারলে বুদ্ধিমূলক কোনো প্ৰণালীতে তাকে জানিবার উপায় নেই । রসসাহিত্য মুখ্যত জ্ঞানের জিনিস নয়, তা মর্মের অধিগম্য । তাই, সেখানে কেবল অর্থ যথেষ্ট নয়, সেখানে ধ্বনির প্রয়োজন ; কেননা ধ্বনি বেগবান । ছন্দের বন্ধনে এই ধ্বনিবেগ পায় বিশিষ্টতা, পায় প্রবলতা । নিত্যব্যবহারের ভাষাকে ব্যাকরণের নিয়মজাল দিয়ে বাধতে হয় । রাসপ্রকাশের ভাষাকে বাধতে হয় ধ্বনিসংগতের নিয়মে । সমাজেই বলো, ভাষাতেই বলো, সাধারণ ব্যবহারবিধির প্রয়োজন বাইরের দিকে, কিন্তু তাতেই সম্পূর্ণতা নেই। আর-একটা বিধি আছে যেটা আত্মিকতার বিধি । সমাজের দিক থেকে একটা দৃষ্টান্ত দেখানো যাক । জাপানে গিয়ে দেখা গেল জাপানি সমাজস্থিতি । সেই স্থিতি ব্যবস্থাবন্ধনে । সেখানে চোরকে ঠেকায় পুলিস, জুয়াচোরকে দেয় সাজা, পরস্পরের দেনাপাওনা পরস্পরকে আইনের তাড়ায় মিটিয়ে দিতে হয় । এই যেমন স্থিতির দিক তেমনি গতির দিক আছে ; সে চরিত্রে, যা চলে যা চালায় । এই গতি হচ্ছে অন্তর থেকে উদগর্ত সৃষ্টির গতি, এই গতিপ্রবাহে জাপানি মনুষ্যত্বের আদর্শ নিয়ত রূপ গ্ৰহণ করে । জাপানি সেখানে ব্যক্তি, সর্বদাই তার ব্যঞ্জনা চলছে । সেখানে জাপানির নিত্য-উদ্ভাবিত সচল সত্তার পরিচয় পাওয়া গেল । দেখতে পেলেম, স্বভাবতই জাপানি রূপকার । কেবল যে শিল্পে সে আপন সীেষম্যবোধ প্ৰকাশ করছে তা নয়, প্ৰকাশ করছে আপনি ব্যবহারে । প্ৰতিদিনের আচরণকেও সে শিল্পসামগ্ৰী করে তুলেছে, সীেজন্যে তার শৈথিল্য নেই। আতিথেয়তায় তার দাক্ষিণ্য আছে, হৃদ্যতা আছে, বিশেষভাবে আছে সুষমা । জাপানের বৌদ্ধমন্দিরে গেলেম । মন্দিরসজায়, উপাসকদের আচরণে অনিন্দ্যনির্মল শোভনতা । বহুনৈপুণ্যে নির্মিত মন্দিরের ঘন্টার গভীর মধুর ধ্বনি মনকে আনন্দে আন্দোলিত করে । কোথাও সেখানে এমন কিছুই নেই। যা মানুষের কোনো ইন্দ্ৰিয়কে কদৰ্যতা বা অপারিপাট্যে অবমানিত করতে পারে । এইসঙ্গে দেখা যায় পৌরুষের অভিমানে জাপানির প্রাণপণ নিভীকতা। চারুতা ও বীর্যের সম্মিলনে এই যে তার আত্মপ্রকাশ, এ তো ফৌজদারি দণ্ডবিধির ; সৃষ্টি নয়। অথচ, জাপানির ব্যক্তিস্বরূপ বন্ধনের সৃষ্টি, তার পরিপূর্ণতা সীমার দ্বারাতেই। নিয়ত প্ৰকাশমান চলমান এই তার প্রকৃতিকে শক্তিদান রূপদান করে যে আন্তরিক বন্ধন, যে সজীব সীমা, তাকেই বলি ছন্দ । আইনের শাসনে সমাজহিতি, অন্তরের ছন্দে আত্মপ্রকাশ ।