পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6 ዓ ዔ বিংশতিকোটি মানবের বাস এ ভারতভূমি যবনের দাস রয়েছে পড়িয়া শৃঙ্খলে বাধা । আর্যাবর্তজয়ী মানব যাহারা সেই বংশোদ্ভব জাতি কি ইহারা, জন কত শুধু প্রহরী-পাহারা দেখিয়া নয়নে লেগেছে ধাধা । দেখা যাচ্ছে, ছন্দের বন্ধনে শব্দগুলোকে শৈথিল থেকে বাচিয়ে রেখেছে, এলিয়ে পড়ছে না, তারা একটা বিশেষ রূপ নিয়ে চলেছে | বাধন ভেঙে দেওয়া যাক । “ভারতভূমিতে বিংশতিকোটি মানব বাস করিয়া থাকে, তথাপি এই দেশ দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া আছে । যাহারা একদা আর্যবর্তী জয় করিয়াছিল ইহারা কি সেই বংশ হইতে উদ্ভূত। কয়েকজনমাত্র প্রহরীর পরিক্রমণ দেখিয়াই ইহাদের চক্ষুতে কি দৃষ্টিবিভ্ৰম ঘটিয়াছে।’ কথাগুলোর কোনো লোকসান হয় নি, বরঞ্চ হিসাব করে দেখলে কয়েক পারসেনট মুনাফাই দেখা যায় । কিন্তু কেবল ব্যাকরণের বাধনে কথাগুলোকে অন্তরের দিকে সংঘবদ্ধ করে নি, তারই অভাবে সে শক্তি হাবিয়েছে । উদাস মনের রুদ্ধ দ্বার ভাঙবার উদ্দেশে সবাই মিলে এক হয়ে ঘা দিতে পারছে ছন্দর সঙ্গে আছন্দর তফাত এই যে, কথা একটাতে চলে, আর-একটাতে শুধু বলে কিন্তু চলে না । যে চলে সে কখনো খেলে, কখনো নাচে, কখনো লড়াই করে, হাসে কাদে ; যে স্থির বসে থাকে। সে আপিস চালায়, তর্ক করে, বিচার করে, হিসাব দেখে, দল পাকায় । ব্যবসায়ীর শুষ্ক প্রবীণতা ছন্দোহীন বাকো, অব্যবসায়ীর সরাসচঞ্চল প্ৰাণের বেগ ছন্দোময় ছবিতে কাব্যে গানে । এই ছবি-গান-কাব্যকে আমরা গড়ে-তোলা জিনিস বলে অনুভব করি নে ; মনে লাগে, যেন তারা হয়ে-ওঠা পদাৰ্থ । তাদের মধ্যে উপাদানের বাহ্য সংঘটনটা অত্যন্ত বেশি ধরা দেয় না ; দেখা যায় উদ্ভাবনার একটা অখণ্ড প্রকাশ, যে প্রকাশ একান্তভাবে আমাদের বোধের সঙ্গে মেলে। বিশ্বসৃষ্টিতে স্পন্দিত আকাশ, কম্পিত বাতাস, চঞ্চল হৃদয়াবেগ স্নায়ুতন্তুতে ছন্দোবিভঙ্গিত হয়ে আলোতে গানেতে বেদনায় আমাদের চৈতনো কেবলই একে দিচ্ছে। আলিম্পন । ছবি-গান-কাব্যও আপনি ছন্দঃস্পেন্দনের চলদবেগে আমাদের চৈতন্যকে গতিমান আকৃতিমান করে তুলছে নানাপ্রকার চাঞ্চল্যে । অন্তরে যেটা এসে প্রবেশ করছে সেটা মিলে যাচ্ছে আমাদের চৈতন্যে, সে আর স্বতন্ম থাকছে না । ঘোড়ার ছবি দেখি প্ৰাণিতত্ত্বের বইয়ে । সেখানে ঘোড়ার আকৃতির সঙ্গে তার অঙ্গপ্রতাঙ্গের সমন্ত হিসাব ঠিকঠাক মেলে । তাতে খবর পাই, সে খবর বাইরের খবর ; তাতে জ্ঞানলাভ করি, ভিতরটা খুশি হয়ে ওঠে না । এই খবরটা স্থাবর পদার্থ। । রূপকার ঘোড়ার যে ছবি আঁকে তার চরম উদ্দেশ্য খবর নয় খুশি, এই খুশিটা বিচলিত চৈতন্যের বিশেষ উদবোধন । ভালো ছবির মধ্যে বরাবরের মতো একটা সচলতার বেগ রয়েই গেল, তাকে বলা চলে পরপেচুয়ল মুভমেনট ; প্রাণিতত্ত্বের বইয়ে ঘোড়ার ছবিটা চারি দিকেই সঠিক করে বাধা, ধাটি খবরের যাথার্থ্যে পিলপে-গাড়ি করা তার সীমানা । রূপকারের রেখায় রেখায় তার তুলি মৃদঙ্গর বোল বাজিয়েছে, দিয়েছে সুষমার নাচের দোলা । সেই ঘোড়ার ছবিতে চতুষ্পদজাতীয় জীবের খাটি খবর না মিলতেও পারে, মিলবে ছন্দ যার নাড়া খেয়ে সচকিত চৈতন্য সাড়া দিয়ে বলে ওঠে 'ই এই তো বটে। আপনারই মধ্যে সেই সৃষ্টিকে সে স্বীকার করে, সেই থেকে চিরকালের মতো সেই ধ্বনিময় রূপ আমাদের বিশ্বপরিচয়ের অন্তর্গত হয়ে থাকে । আকাশ কালো মেঘে স্নিগ্ধ, বনভূমি তমালগাছে শ্যামবর্ণ, ব্যাপারটা এর বেশি কিছুই নয় ; খবরটা ১. আরম্ভ হইতে প্রবন্ধের এই অনুচ্ছেদ পর্যন্ত অংশ সাময়িক পত্র হইতে গৃহীত হইয়াছে।