পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছন্দ (፩br S) ধ্বনিছে তাই মন্দবায়ে ছন্দে তারি কুন্দকুল ঝরিছে কত, চঞ্চলিয়া কঁপিছে কাশগুচ্ছশিখা । এ ছন্দ পােচ মাত্রার মাঝখানে ভাগ করে থামতে পারে না ; এর ব্যতিস্থাপনায় বৈচিত্র্যের যথেষ্ট স্বাধীনতা নেই । এবার দেখানো যাক তিন-চার মাত্রার ছন্দ । মালতী সারাবেলা ঝরিছে রহি রহি কেন যে বুঝি না তো । হায় রে উদাসিনী, পথের ধূলিরে কি করিলি অকারণে মরণসহচরী । অরুণ গগনের ছিলি তো সোহগিনি । শ্রাবণবরিষনে মুখর বনভূমি তোমারি গন্ধের গৰ্ব্ব প্রচারিছে সিক্ত সমীরণে দিশে দিশান্তরে । কী অনাদরে তবে গোপনে বিকশিয়া বাদল-রজনীতে প্ৰভাত-আলোকেরে কহিলি ‘নহে নহে । উপরের দৃষ্টান্তগুলি থেকে দেখা যায়, অসম ও বিষম মাত্রার ছন্দে পঙক্তিলঙ্ঘন চলে বটে, কিন্তু তার এক-একটি ধ্বনিগুচ্ছ সমান মাপের, তাতে ছোটো-বড়ো ভাগের বৈচিত্র্য নেই। এইজন্যেই একমাত্র পয়ারছন্দই অমিত্ৰাক্ষর রীতিতে কতকটা গদ্য-জাতীয় স্বাধীনতা পেয়েছে । এইবার আমার শ্রোতাদের মনে করিয়ে দেবার সময় এল যে, এই সব পঙক্তিলঙ্ঘক ছন্দের কথাটা উঠেছে প্রসঙ্গক্রমে । মূলকথাটা এই যে, কবিতায় ক্ৰমে-ক্রমে ভাষাগত ছন্দের আঁটা-আঁটির সমান্তরে ভাবগত ছন্দ উদভাবিত হচ্ছে। পূর্বেই বলেছি, তার প্রধান কারণ, কবিতা এখন কেবলমাত্র শ্রাব্য নয়, তা প্ৰধানত পাঠ্য । যে সুনিবিড় সুনিয়মিত ছন্দ আমাদের স্মৃতির সহায়তা করে তার অত্যাবশ্যকতা এখন আর নেই । একদিন খনার বচনে চাষাবাসের পরামর্শ লেখা হয়েছিল ছন্দে । আজকালকার বাংলায় যে “কৃষ্টি শব্দের উদভব হয়েছে খনার এই সমস্ত কৃষির ছড়ায় তাকে নিশ্চিত এগিয়ে দিয়েছিল । কিন্তু এই ধরনের কৃষ্টি প্রচারের ভার। আজকাল গদা নিয়েছে। ছাপার অক্ষর তার বাহন, এইজন্যে ছন্দের পুঁটুলিতে ঐ বচনগুলো মাথায় করে বয়ে বেড়াবার দরকার হয় না। একদিন পুরুষও আফিসে যেতে পালকিতে, মেয়েও সেই উপায়েই যেত শ্বশুরবাড়িতে । এখন রেলগাড়ির প্রভাবে উভয়ে একত্রে একই রথে জায়গা পায় । আজকাল গদ্যের অপরিহার্য প্রভাবের দিনে ক্ষণে-ক্ষণে দেখা যাবে কাব্যও আপন গতিবিধির জন্যে বাধাছন্দের ময়ুরপংখিটাকে অত্যাবশ্যক বলে গণ্য করবে না । পূর্বেই বলেছি, অমিত্ৰাক্ষর ছন্দে সাব-প্রথমে পালকির দরজা গেছে খুলে, তার ঘটাটােপ হয়েছে বর্জিত। তবুও পয়ার যখন পঙক্তির বেড়া ডিঙিয়ে চলতে শুরু করেছিল তখনো সাবেকি চালের পরিশেষরূপে গণ্ডির চিহ্ন পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে রয়ে গেছে। ঠিক যেন পুরানো বাড়ির অন্দরমহল ; তার দেয়ালগুলো সরানো হয় নি, কিন্তু আধুনিককালের মেয়েরা তাকে অস্বীকার করে অনায়াসে সদরে যাতায়াত করছে । অবশেষে হাল-আমলের তৈরি ইমারতে সেই দেওয়ালগুলো ভাঙা শুরু হয়েছে । চোদ্দ অক্ষরের গণ্ডিভাঙা পয়ার একদিন 'মানসীর এক কবিতায় লিখেছিলুম, তার নাম নিৰ্ম্মফল-প্ৰয়াস’ । অবশেষে আরো অনেক বছর পরে বেড়াভাঙা পয়ার দেখা দিতে লাগল। ‘বলাকায়, ১ বস্তুত "নিৰ্ম্মফল-কামনা’ ।