পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছন্দ GS মিলিল। কিন্তু, ইহার মধ্যে ছয় মাত্রা কিছুতেই সইবে না। যেমন, “তোমারি নীলবাসে ধরিল শরীর । অথচ, প্ৰথম অংশে যদি হুয়ের ভাগ থাকিত তবে দিব্য চলিত। যেমন, “তোমার সুনীল বাসে ধরিল শরীর' । এ আমি বলিতেছি। কানের স্বাভাবিক রুচির কথা । এই কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিবার পথ । অতএব, এই কানের কাছে যদি ছাড় মেলে। তবে ওস্তাদকে কেন ডরাইব । আমার দৃষ্টিান্তগত ছন্দটিতে প্ৰত্যেক লাইনেই সবসুদ্ধ ১১ মাত্ৰা আছে। কিন্তু এমন ছন্দ হইতে পারে যার প্রত্যেক লাইনে সমান মাত্ৰাবিভাগ নাই । যেমন বাজিবে, সখী, বাঁশি বাজিবে, হৃদয়রাজ হদে রাজিবে । বচন রাশি রাশি কোথা যে যাবে ভাসি, অধরে লাজহাসি সাজিবে । ইহার প্রথম দুই লাইনে মাত্রা ভাগ ৩+ ৪ + ৩ = ১০ । তৃতীয় লাইনে ৩+৪+৩+৪=১৪ । , আমার মতে এই বৈচিত্র্যে ছন্দের মিষ্টতা বাড়ে । অতএব, উৎসাহ করিয়া গান ধরিলাম। কিন্তু, এক ফের ফিরিতেই তালওয়ালা পথ আটক করিয়া বসিল । সে বলিল, “আমার সমের মাসুল চুকাইয়া দাও ।” আমি তো বলি, এটা বে-আইনি আবোয়াব । কান মহারাজার উচ্চ আদালতে দরবার করিয়া খালাস পাই। কিন্তু, সেই দরবারের বাহিরে খাড়া আছে মাঝারি শাসনতন্ত্রের দারোগা । সে খপ করিয়া হাত চাপিয়া ধরে, নিজের বিশেষ বিধি খাটায়, রাজার দোহাই মানে না । কবিতায় যেটা ছন্দ, সংগীতে সেইটেই লয়। এই লয় জিনিসটি সৃষ্টি ব্যাপিয়া আছে, আকাশের তারা হইতে পতঙ্গের পাখা পর্যন্ত সমন্তই ইহাকে মানে বলিয়াই বিশ্বসংসার এমন করিয়া চলিতেছে অথচ ভাঙিয়া পড়িতেছে না। অতএব, কাব্যেই কী গানেই কী, এই লয়কে যদি মানি তবে তালের সঙ্গে বিবাদ ঘটিলেও ভয় করিবার প্রয়োজন নাই । একটি দৃষ্টান্ত দিই— ব্যাকুল বকুলের ফুলে ভ্ৰমর মরে পথ ভুলে । আকাশে কী গোপন বাণী বাতাসে করে কানাকানি, বনের অঞ্চলখানি পুলকে উঠে দুলে দুলে। বেদনা সমধুর হয়ে ভুবনে গোল আজি বয়ে । , বাঁশিতে মায়া তান পুরি কে আজি মন করে চুরি, নিখিল তাই মরে ঘুরি বিরহসাগরের কুলে। এটা যে কী তাল তা আমি আনাড়ি জানি না। এবং কোনাে ওস্তাদও জানেন না। গণিয়া দেখিলে দেখি প্রত্যেক লাইনে নয় মাত্রা । যদি এমন বলা যায় যে, নাহয় নয় মাত্রায় একটা নূতন তালের সৃষ্টি করা যাক, তবে আর-একটা নয়। মাত্রার গান পরীক্ষা করিয়া দেখা যাক ।