পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

更响 r Gh ‘পূণ্যবান শব্দটি “কাশীরাম শব্দের সমান ওজনের নহে। কিন্তু, আমরা প্রত্যেক বর্ণটিকে সুর করিয়া টানিয়া টানিয়া পড়ি বলিয়া আমাদের শব্দগুলির মধ্যে এতটা ফাক থাকে যে, হালকা ও ভারী দুইরকম শব্দই সমমাত্রা অধিকার করিতে পারে ।-- Equality Fraternity প্রভৃতি পদার্থগুলি খুব মূল্যবান বটে, কিন্তু সেইজন্যই বুটা হইলে তাহা ত্যাজ্য হয়। আমাদের সাধুছন্দে বর্ণগুলির মধ্যে সাম্য ও সৌভ্রাত্র দেখা যায় তাহা গানের সুরে সঁাচ্চা হইতে পারে, কিন্তু আবৃত্তি করিয়া পড়িবার প্রয়োজনে তাহা কুটা । এই কথাটা অনেকদিন আমার মনে বাজিয়াছে। কোনো কোনো কবি ছন্দের এই দীনতা দূর করিবার জন্য বিশেষ জোর দিবার বেলায় বাংলা শব্দগুলিকে সংস্কৃতের রীতি-অনুযায়ী স্বরের হ্রস্ব দীর্ঘ রাখিয়া ছন্দে বসাইবার চেষ্টা করিয়াছেন । ভারতচন্দ্ৰে তাহার দুই-একটা নমুনা আছে। যথা মহারুদ্র বেশে মহাদেব সাজে । বৈষ্ণব কবিদের রচনায় এরাপ অনেক দেখা যায় ।- কিন্তু, এগুলি বাংলা নয় বলিলেই হয় । ভারতচন্দ্ৰ যেখানে সংস্কৃত ছন্দে লিখিয়াছেন, সেখানে তিনি বাংলা শব্দ যতদূর সম্ভব পরিত্যাগ করিয়াছেন এবং বৈষ্ণব কবিরা যে ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন তাহা মৈথিলী ভাষার বিকার । আমার বড়দাদা মাঝে মাঝে এ কাজ করিয়াছেন, কিন্তু তাহা কৌতুক করিয়া যথা ইচ্ছা সম্যক ভ্ৰমণগমনে কিন্তু পাথেয় নান্তি । পায়ে শিকী মন উড় উড় এ কি দৈবেরি শান্তি ! বাংলায় এ জিনিস চলিবে না ; কারণ বাংলায় হ্রস্বদীর্ঘস্বরের পরিমাণভেদ সুব্যক্ত নহে। কিন্তু, যুক্ত ও অযুক্ত বর্ণের মাত্রাভেদ বাংলাতেও না ঘটিয়া থাকিতে পারে না।-- সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার একটা প্ৰভেদ এই যে, বাংলার প্রায় সর্বত্রই শব্দের অন্তস্থিত অ-স্বরবর্ণের উচ্চারণ হয় না । যেমন- ফল, জল, মাঠ, ঘাট, চাদ, ফাদ, বান্দর, আদর ইত্যাদি । ফল শব্দ বস্তুত এক মাত্রার কথা । অথচ সাধু বাংলাভাষার ছন্দে ইহাকে দুই মাত্ৰা বলিয়া ধরা হয়। অর্থাৎ ফলা এবং ফল বাংলা ছন্দে একই ওজনের । এইরূপে বাংলা সাধুছন্দে হসন্ত জিনিসটাকে একেবারে ব্যবহারে লাগানো হয় না। অথচ জিনিসটা ধ্বনি উৎপাদনের কাজে ভারি মজবুত। হসন্ত শব্দটা স্বরবর্ণের বাধা পায় না বলিয়া পরবতী শব্দের ঘাড়ের উপর পড়িয়া তাহাকে ধাকা দেয় ও বাজাইয়া তোলে । ‘করিতেছি' শব্দটি ভেঁাতা। উহাতে কোনো সুর বাজে না কিন্তু ‘কটি শব্দে একটা সুর আছে। যাহা হইবার তাহাই হইবে।” এই বাক্যের ধবনিটা অত্যন্ত টিলা ; সেইজন্য ইহার মধ্যেও একটা আলস্য প্ৰকাশ পায় । কিন্তু, যখন বলা যায় “যা হবার তাই হবে তখন হবার শব্দের হসন্ত-‘র’ তাই শব্দের উপর আছাড় খাইয়া একটা জোর জাগাইয়া তোলে ; তখন উহার নাকী সুর ঘুচিয়া গিয়া ইহা হইতে একটা মরিয়া ভাবের আওয়াজ বাহির হয় । বাংলার হসন্তবর্জিত সাধুভাবাটা বাবুদের আদুরে ছেলেটার মতো মোটাসোটা গোলগাল ; চর্বির অন্তরে তাহার চেহারাটা একেবারে ঢাকা পড়িয়া গেছে, এবং তাহার চিৰুণতা যতই থােক, তাহার জোর অতি অল্পই। কিন্তু, বাংলার অসাধু ভাষাটা খুব জোরালো ভাষা, এবং তাহার চেহারা বলিয়া একটা পদাৰ্থ আছে। আমাদের সাধু ভাষার কাব্যে এই অসাধু ভাষাকে একেবারেই আমল দেওয়া হয় নাই ; কিন্তু, তাই বলিয়া অসাধু ভাষা যে বাসায় গিয়া মরিয়া আছে তাহা নহে। সে আউলের মুখে, বাউলের মুখে, ভক্ত কবিদের গানে, মেয়েদের ছড়ায় বাংলাদেশের চিত্তটাকে একেবারে শ্যামল করিয়া হইয়া রহিয়াছে। কেবল ছাপায় কালির তিলক পরিয়া সে ভদ্রসাহিত্যসভায় মোড়লি করিয়া বেড়াইতে পারে না । কিন্তু, তাহার কণ্ঠে গান থামে নাই, তাহার বাশের বঁশি বাজিতেছেই । সেই সব মেঠো-গানের ঝরনার তলায় বাংলাভাষার হসন্তা-শব্দগুলা নুড়ির মতো পরস্পরের উপর পড়িয়া ঠুনঠুন শব্দ করিতেছে। আমাদের ভদ্রসাহিত্যপীর গভীর দিঘিটার স্থির জলে সেই শব্দ নাই ; সেখানে হসন্তর ঝংকার বন্ধ । আমার শেষ বয়সের কাব্য-রচনায় আমি বাংলার এই চলতি ভাবার সুরটাকে ব্যবহারে লাগাইবার চেষ্টা করিয়াছি । কেননা দেখিয়াছি, চলতি ভাষাটাই স্রোতের জলের মতো চলে, তাহার নিজের একটি