পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

წლ* &98 (ሰ তার যেটি আদর্শ, এই চিঠিতে তারই আলোচনা চলছে। বক্ষ্যমাণ কাব্যে গদ্যটি মাংসপেশল পুরুষ বলেই কিছু প্রাধান্য যদি নিয়ে থাকে। তবু তার কলাবতী বধু দরজার আধাখোলা অবকাশ দিয়ে উকি মারছে, তার সেই ছায়াবৃত কটাক্ষ-সহযোগে সমস্ত দৃশ্যটি রসিকদের উপভোগ্য হবে বলেই ভরসা। করেছিলুম। এর মধ্যে ছন্দ নেই বললে অত্যক্তি হবে, ছন্দ আছে বললেও সেটাকে বলব স্পর্ধা। তবে কী বললে ঠিক হবে ব্যাখ্যা করি । ব্যাখ্যা করব কাব্যরস দিয়েই । বিবাহসভায় চন্দনচর্চিত বর-কনে টােপর মাথায় আলপনা-আঁকা পিড়ির উপর বসেছে। পুরুত পড়ে চলেছে মন্ত্র, ও দিকে আকাশ থেকে আসছে সাহানা-রাগিণীতে সানাইয়ের সংগীত । এমন অবস্থায় উভয়ের যে বিবাহ চলেছে সেটা নিঃসন্দিগ্ধ, সুস্পষ্ট । নিশ্চিত-ছন্দ-ওয়ালা কাব্যে সেই সানাই বাজনা সেই মন্ত্রপড়া লেগেই আছে । তার সঙ্গে আছে লাল চেলি, বেনারসির জোড়, ফুলের মালা, ঝাড়লন্ঠনের রোশনাই । সাধারণত যাকে কাব্য বলি সেটা হচ্ছে বচন-অনির্বাচনের সদ্যমিলনের পরিভূষিত উৎসব । অনুষ্ঠানে যা যা দরকার সযত্নে তা সংগ্ৰহ করা হয়েছে। কিন্তু, তার পরে ? অনুষ্ঠান তো বারোমাস চলবে না। তাই বলেই তো নীরবিত সাহান-সংগীতের সঙ্গে সঙ্গেই বরবধুর মহাশূন্যে অন্তর্ধান কেউ প্রত্যাশা করে না । বিবাহ-অনুষ্ঠানটা সমাপ্ত হল, কিন্তু বিবাহটা তো রইল, যদি-না কোনো মানসিক বা সামাজিক উপানিপাত ঘটে । এখন থেকে সাহানা-রাগিণীটা অশ্রদ্রুত বাজবে, এমন-কি, মাঝে মাঝে তার সঙ্গে বেসুরো নিখাদে অত্যন্তৰ্গত কড়া সুরও না-মেশা অস্বাভাবিক, সুতরাং একেবারে না-মেশা প্রার্থনীয় নয় । চেলি-বেনাবসিটা তোলা রইল, আবার কোনো অনুষ্ঠানের দিনে কাজে লাগবে । সপ্তপদীর বা চতুর্দশপদীর পদক্ষেপটা প্রতিদিন মানায় না । তাই বলেই প্রাত্যহিক পদক্ষেপটা অস্থানে পড়ে বিপদজনক হবেই এমন আশঙ্কা করি নে। এমন-কি. বাম দিক থেকে রুনুকুনু মলের আওয়াজ গোলমালের মধ্যেও কানে আসে । তবু মোটের উপর বেশভূষাটা হল আটপৌরে । অনুষ্ঠানের বাধাবীতি থেকে ছাড়া পেয়ে একটা সুবিধে হল এই যে, উভয়ের মিলনের মধ্যে দিয়ে সংসাৱযাত্রাব বৈচিত্র সহজ রূপ নিয়ে স্কুল সূক্ষ্ম নানা ভাবে দেখা দিতে লাগল। যুগলমিলন নেই অথচ সংসারযাত্ৰা আছে এমনও ঘটে ! কিন্তু, সেটা লক্ষ্মীছাড়া । যেন খবুরে-কাগজি সাহিত্য । কিন্তু, যে সংসাবটা প্রতিদিনের, অথচ সেই প্রতিদিনকেই লক্ষ্মীশ্ৰী চিরদিনের করে তুলছে, যাকে চিরন্তনের পরিচয় দেবার জনো বিশেষ বৈঠকখানায় অলংকৃত আয়োজন করতে হয় না। তাকে কাব্যশ্রেণীতেই গণা করি । অথচ চেহারায় সে গদ্যোর মতো হতেও পারে । তার মধ্যে বেসুর আছে, প্রতিবাদ আছে, নানাপ্রকার বিমিশ্রতা আছে, সেইজনোই চারিত্ৰশক্তি আছে। যেমন কর্ণের চরিত্ৰশক্তি যুধিষ্ঠিরের চেয়ে অনেক বড়ো । অথচ, একরকম শিশুমতি আছে যারা ধর্মীরাজের কাহিনী শুনে অশ্রুবিগলিত হয় । রামচন্দ্ৰ নামটার উল্লেখ করলুম না সে কেবল লোকভয়ে, কিন্তু আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আদিকবি বাল্মীকি রামচন্দ্ৰকে ভূমিকাপত্তনম্বরূপে খাড়া করেছিলেন তার অসবৰ্ণতায় লক্ষ্মণের চরিত্রকে উজ্জ্বল করে আকবার জনোই, এমন-কি হনুমানের চরিত্রকেও বাদ দেওয়া চলবে না । কিন্তু, সেই একঘেয়ে ভূমিকাটা অত্যন্ত বেশি রঙফলানো চওড়া বলেই লোকে ঐটেক. দিকে তাকিয়ে হায়-হায় করে । ভবভূতি তা করেন নি । তিনি রামচন্দ্রের চরিত্রকে আশ্রদ্ধেয় করবার জন্যেই কবিজনে৷াচিত কৌশলে গঞ্জ নারীপে । ঐ দেখো, কী কথা বলতে কী কথা এসে পড়ল। আমার বক্তব্য ছিল এই— কাব্যকে বেড়াভাঙা গদ্যের ক্ষেত্রে স্ত্রীস্বাধীনতা দেওয়া যায় যদি, তাহলে সাহিত্যসংসারের আলংকারিক অংশটা হালকা হয়ে তার বৈচিত্রের দিক তার চরিত্রের দিক অনেকটা খোলা জায়গা পায় । কাব্য জোরে পা ফেলে চলতে পারে । সেটা সযত্নে নোচে চলার চেয়ে সব সময়ে যে নিন্দনীয় তা নয় । নাচের আসরের বাইরে আছে এই উচুনিচু বিচিত্র বৃহৎ জগৎ রাঢ় অথচ মনোহর, সেখানে জোরে চলাটাই মানায় ভালো, কখনো ঘাসের উপর, কখনো কাকরের উপর দিয়ে । রোসো । নাচের কথাটা যখন উঠল, ওটাকে সেরে নেওয়া যাক । নাচের জন্য বিশেষ সময়, বিশেষ