পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে S ১১ এপ্রেল, ১৯৩২ । দেশ থেকে বেরবার বয়স গেছে এইটেই স্থির করে বসেছিলুম। এমন সময় পারস্যরাজের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ এল । মনে হল এ নিমন্ত্ৰণ অস্বীকার করা অকর্তব্য হবে । তবু সত্তর বছরের ক্লান্ত শরীরের পক্ষ থেকে দ্বিধা ঘোচে নি। বোম্বাই থেকে আমার পারসী বন্ধু দিনশা ইরানী ভরসা দিয়ে লিখে পাঠালেন যে, পারস্যের বুশেয়ার বন্দর থেকে তিনিও হবেন আমার সঙ্গী। তা ছাড়া খবর দিলেন যে, বোম্বাইয়ের পারসিক কনসাল কেহান সাহেব পারসিক সরকারের পক্ষ থেকে আমার যাত্রার সাহচর্য ও ব্যবস্থার ভার পেয়েছেন । এর পরে ভীরুতা করতে লজা বোধ হল । রেলের পথ এবং পারস্য উপসাগর সেই গরমের সময় আমার উপযোগী হবে না বলে ওলন্দাজদের বায়ুপথের ডাকযোগে যাওয়াই স্থির হল । কথা রইল আমার শুশ্রষার জন্যে বউমা যাবেন সঙ্গে, আর যাবেন কর্মসহাযরাপে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ও অমিয় চক্রবতী । এক বায়ুযানে চারজনের ফলায়গা হবে না বলে কেদারনাথ এক সপ্তাহ আগেই শূন্যপথে রওনা হয়ে গেলেন । পূর্বে আর-একবার এই পথের পরিচয় পেয়েছিলুম লন্ডন থেকে প্যারিসে । কিন্তু সেখানে যে ধরাতল ছেড়ে উধের্ণ উঠেছিলুম তার সঙ্গে আমার বন্ধন ছিল আলগা । তার জল-স্থল আমাকে পিছুডাক দেয় না, তাই নোঙর তুলতে টানাটানি করতে হয় নি । এবারে বাংলাদেশের মাটির টান কাটিয়ে নিজেকে শূন্যে ভাসান দিলুম, হৃদয় সেটা অনুভব করলে । কলকাতার বাহিরের পল্লীগ্রাম থেকে যখন বেরলাম তখন ভোরবেলা । তারাখচিত নিস্তািন্ধ অন্ধকারের নীচে দিয়ে গঙ্গার স্রোত ছলছল করছে। বাগানের প্রাচীরের গায়ে সুপুরিগাছের ডাল দুলছে বাতাসে, লতাপাত-ঝোপঝাপের বিমিশ্র নিশ্বাসে একটা শ্যামলতার গন্ধ আকাশে ঘনীভূত । নিদ্রিত গ্রামের আঁকাবঁকা সংকীর্ণ গলির মধ্য দিয়ে মোটর চলল। কোথাও-বা দাগ-ধরা পুরোনো পাকা দালান, তার খানিকটা বাসযোগ্য, খানিকটা ভেঙে-পড়া ; আধা-শহুরে দোকানে দ্বার বন্ধ ; শিবমন্দির জনশূন্য ; এবড়ো-খেবড়ো পোড়ো জমি ; পানাপুকুর ; ঝোপঝাড় । পাখিদের বাসায় তখনো সাড়া পড়ে নি, জোয়ার-ভাটার সন্ধিকালীন গঙ্গার মতো পল্লীর জীবনযাত্রা ভোরবেলাকার শেষ ঘুমের মধ্যে থমকে আছে | গলির মোড়ে নিযুপ্ত বারান্দায় খাটিয়া-পাতা পুলিস-থানার পাশ দিয়ে মোটর পীেছল বড়ো রাস্তায় । অমনি নতুন কালের কড়া গন্ধ মেলে ধুলো জেগে উঠল, গাড়ির পেট্রোল-বাম্পের সঙ্গে তার সগোত্র আত্মীয়তা । কেবল অন্ধকারের মধ্যে দুই সারি বনস্পতি পূজিত পল্লবন্তবকে প্রাচীন কালের নীরব সাক্ষ্য নিয়ে স্তম্ভিত ; সেই যে কালে শতাব্দী পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে বাংলার ছায়াসিন্ধ অঙ্গনপাৰ্থে অতীত যুগের ইতিহাসধারা কখনো মন্দগাষ্ঠীর গতিতে কখনো ঘূৰ্ণাবর্তসংকুল ফেনায়িত বেগে বয়ে চলেছিল। রাজপরম্পরার পদচিহ্নিত এই পথে কখনো পাঠান, কখনো মোগল, কখনো ভীষণ বগী, কখনো কোম্পানির সেপাই ধুলোর ভাষায় রাষ্ট্রপরিবর্তনের বার্তা ঘোষণা করে যাত্রা করেছে। তখন ছিল হাতি উট তাঞ্জাম ঘোড়সওয়ারদের অলংকৃত ঘোড়া ; রাজপ্রতাপের সেই-সব বিচিত্র বাহন ধুলোর ধূসর