পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve NRVe রবীন্দ্র-রচনাবলী অন্তরালে মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেছে। একমাত্র বাকি আছে সর্বজনের ভারবাহিনী করুণামন্থর গোরুর গাড়ি । দমদমে উড়ো জাহাজের আডিডা ঐ দেখা যায়। প্ৰকাণ্ড তার কোটির থেকে বিজলি বাতির আলো বিছুরিত। তখনো রয়েছে বৃহৎ মাঠজোড়া অন্ধকার। সেই প্রদোষের অস্পষ্টতায় ছায়াশরীরীর মতো বন্ধুবান্ধব ও সংবাদপত্রের দূত জমে উঠতে লাগল। সময় হয়ে এল। ডানা ঘুরিয়ে, ধুলো উড়িয়ে, হাওয়া আলোড়িত করে ঘর্ঘর গর্জনে যন্ত্রপক্ষীরাজ তার গহবর থেকে বেরিয়ে পড়ল খোলা মাঠে । আমি, বউমা, অমিয় উপরে চড়ে বসলাম । ঢাকা রথ, দুই সারে তিনটি করে চামড়ার দোলা-ওয়ালা ছয়টি প্রশস্ত কেদারা, আর পায়ের কাছে আমাদের পথে-ব্যবহার্য সামগ্ৰীীর হালকা বাক্স । পাশে কাচের জানলা । ব্যোমিতিরী বাংলাদেশের উপর দিয়ে যতক্ষণ চলল ততক্ষণ ছিল মাটির কতকটা কাছাকাছি । পানাপুকুরের চারি ধারে সংসাত্ত গ্রামগুলি ধূসর বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝে মাঝে ছোটাে ছোটাে দ্বীপের মতো খণ্ড খণ্ড চোখে পড়ে। উপর থেকে তাদের ছায়াঘনিষ্ঠ শ্যামল মূর্তি দেখা যায় ছাড়া-ছাড়া, কিন্তু বেশ বুঝতে পারি। আসন্ন গ্ৰীষ্মে সমস্ত তুষাসন্তপ্ত দেশের রসনা আজ শুষ্ক । নির্মল নিরাময় জলগাণ্ডুষের জন্যে ইন্দ্রদেবের খেয়ালের উপর ছাড়া আর-কারও ‘পরে এই বহু কোটি লোকের যথোচিত ভরসা। 6न्म२ । মানুষ পশু পাখি কিছু যে পৃথিবীতে আছে সে আর লক্ষ্য হয় না। শব্দ নেই, গতি নেই, প্ৰাণ নেই ; যেন জীববিধাতার পরিত্যক্ত পৃথিবী তালি-দেওয়া চাদরে ঢাকা । যত উপরে উঠছে ততই পৃথিবীর রূপবৈচিত্ৰ্য কতকগুলো আঁচড়ে এসে ঠেকাল । বিস্মতনামা প্ৰাচীন সভ্যতার স্মৃতিলিপি যেন অজ্ঞাত অক্ষবে কোনো মৃতদেশের প্রান্তর জুড়ে ক্ষোদিত হয়ে পড়ে আছে ; তার রেখা দেখা যায়, অর্থ বোঝা या। नीं । প্রায় দশটা ৷ এলাহাবাদের কাছাকাছি এসে বায়ুযান নামবার মুখে কুঁকল। ডাইনের জানলা দিয়ে দেখি নীচে কিছুই নেই, শুধু অতল নীলিমা, বা দিকে আড় হয়ে উপরে উঠে আসছে ভূমিতলটা । খেচর-রথ মাটিতে ঠেকাল এসে ; এখানে সে চলে। লাফাতে লাফাতে, ধাক্কা খেতে খেতে ; অপ্ৰসন্ন পৃথিবীর সম্মতি সে পায় না যেন । শহর থেকে জায়গাটা দূরে । চার দিক ধু ধূ করছে । রৌদ্রতপ্ত বিরস পৃথিবী । নামবার ইচ্ছা হল না । কোম্পানির একজন ভারতীয় ও একজন ইংরেজ কর্মচারী আমার ফোটাে তুলে নিলে । তার পরে খাতায় দু-চার লাইন স্বাক্ষরের দাবি করল। যখন, আমার হাসি পেল । আমার মনের মধ্যে তখন শংকরাচার্যের মোহমুদগরের শ্লোক গুঞ্জরিত । উধৰ্ব্ব থেকে এই কিছু আগেই চোখে পড়েছে নিজীব ধূলিপােটর উপর অদৃশ্য জীবলোকের গোটাকতক স্বাক্ষরের আঁচড় । যেন ভাবী যুগাবসানের প্রতিবিম্ব পিছন ফিরে বর্তমানের উপর এসে পড়েছে । যে ছবিটা দেখলেম সে একটা বিপুল রিক্ততা ; কালের সমস্ত দলিল অবলুপ্ত ; স্বয়ং ইতিবৃত্তবিৎ চিরকালের ছুটিতে অনুপস্থিত ; রিসার্চ-বিভাগের ভিতটা-সূদ্ধ তলিয়ে গেছে মাটির নীচে । এইখানে যন্ত্রটা পেট ভরে তৈল পান করে নিলে । আধা ঘণ্টা থেমে আবার আকাশযাত্রা শুরু । এতক্ষণ পর্যন্ত রথের নাড়া তেমন অনুভব করি নি, ছিল কেবল তার পাখার দুঃসহ গর্জন । দুই কানে তুলো লাগিয়ে জানলা দিয়ে চেয়ে দেখছিলুম। সামনের কেদারায় ছিলেন একজন দিনেমার, ইনি ম্যানিলা দ্বীপে আখের খেতের তদারক করেন, এখন চলেছেন স্বদেশে। গুটােনো ম্যািপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যাত্রাপথের পরিচয় নিচ্ছেন ; ক্ষণে ক্ষণে চলছে চীজ রুটি, চকোলেটের মিষ্টান্ন, খনিজাত পানীয় জল । কলকাতা থেকে বহুবিধ খবরের কাগজ সংগ্রহ করে এনেছেন, আগাগোড়া তাই তন্ন তন্ন করে পড়ছেন একটার পর একটা । যাত্রীদের মধ্যে আলাপের সম্বন্ধ রইল না। যন্ত্রহুংকারের তুফানে কথাবার্তা যায় তলিয়ে । এক কোণে বেতারবার্তিক কানো ঠলি লাগিয়ে কখনো কাজে কখনো ঘুমে কখনো পাঠে মগ্ন ।