পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে とS 。 হয় । বায়ুলোকে এতকাল যা আমাদের মন ভুলিয়েছে সে হচ্ছে ভারের অভাব, সুন্দরের সহজ সঞ্চারণ । এতদিন পরে মানুষ পৃথিবী থেকে ভারটাকে নিয়ে গেল আকাশে । তাই তার ওড়ার যে চেহারা বেরল সে জোরের চেহারা । তার চলা বাতাসের সঙ্গে মিল করে নয়, বাতাসকে পীড়িত করে ; এই পীড়া ভূলোক থেকে আজ গেল দ্যলোকে । এই পীড়ায় পাখির গান নেই, জন্তুর গর্জন আছে। ভূমিতল আকাশকে জয় করে আজ চিৎকার করছে। সূর্য উঠল দিগন্তরেখার উপরে। উদ্ধত যত্নটা অরুণরাগের সঙ্গে আপনি মিল করবার চেষ্টামাত্র করে নি। আকাশনীলিমার সঙ্গে ওর অসবৰ্ণতা বেসুরো, অন্তরীক্ষের রঙমহলে মেঘের সঙ্গে ওর। অমানান রয়ে গেল। আধুনিক যুগের দূত, ওর সেন্টিমেন্টের বালাই নেই ; শোভাকে ও অবজ্ঞা করে ; অনাবশ্যককে কনুইয়ের ধাক্কা মেরে চলে যায় । যখন পূর্বদিগন্ত রাঙা হয়ে উঠল, পশ্চিমদিগন্তে যখন কোমল নীলের উপর শুক্তিশুভ্ৰ আলো, তখন তার মধ্য দিয়ে ঐ যন্ত্রটা প্ৰকাণ্ড একটা কালো তেলাপোকার মতো ভন ভন করে উড়ে চলল । বায়ুতরী যতই উপরে উঠল ততই ধরণীর সঙ্গে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্ৰিয়ের যোগ সংকীর্ণ হয়ে একটা মাত্র ইন্দ্ৰিয়ে এসে ঠেকাল, দৰ্শন-ইন্দ্ৰিয়ে, তাও ঘনিষ্ঠভাবে নয় । নানা সাক্ষ্য মিলিয়ে যে পৃথিবীকে বিচিত্র ও নিশ্চিত করে জেনেছিলুম। সে ক্রমে এল ক্ষীণ হয়ে, যা ছিল তিন আয়তনের বাস্তব তা হয়ে এল দুই আয়তনের ছবি । সংহত দেশকালের বিশেষ বিশেষ কাঠামোর মধ্যেই সৃষ্টির বিশেষ বিশেষ রূপ । তার সীমানা যতই অনির্দিষ্ট হতে থাকে, সৃষ্টি ততই চলে বিলীনতার দিকে । সেই বিলায়ের ভূমিকার মধ্যে দেখা গেল পৃথিবীকে, তার সত্তা হল অস্পষ্ট, মনের উপর তার অস্তিত্বের দাবি এল কমে। মনে হল, এমন অবস্থায় আকাশযানের থেকে মানুষ যখন শতয়ী বর্ষণ করতে বেরয় তখন সে নির্মমভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ; যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্ৰস্ত করে না, কেননা, হিসাবের অন্ধটা অদৃশ্য হয়ে যায় । যে বাস্তবের পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে । গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়ো জাহাজ- অর্জনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর । বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক তত্ত্বনির্মিত উড়ো জাহাজ মানুষের অন্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে । সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্তনাবাক্য এই যে, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে । বোগদাদে ব্রিটিশদের আকাশফৌজ আছে। সেই ফৌজের খুস্টান ধর্মযাজক আমাকে খবর দিলেন, এখানকার কোন শেখদের গ্রামে তারা প্রতিদিন বোমা বর্ষণ করছেন । সেখানে আবালবৃদ্ধবনিতা যারা মরছে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উদ্ধৰ্ব্বলোক থেকে মার খাচ্ছে ; এই সাম্রাজনীতি ব্যক্তিবিশেষের সত্তাকে অস্পষ্ট করে দেয় বলেই তাদের মাের এত সহজ । খৃস্ট এই-সব মানুষকেও পিতার সন্তান বলে স্বীকার করেছেন, কিন্তু খৃস্টান ধর্মযাজকের কাছে সেই পিতা এবং তার সন্তান হয়েছে অবাস্তব, তাদের সাম্রাজ্যতত্ত্বের উড়ো জাহাজ থেকে চেনা গেল না। তাদের, সেইজন্যে সাম্রাজ্য জুড়ে আজ মাের পড়ছে সেই খৃস্টেরই বুকে । তা ছাড়া উড়ো জাহাজ থেকে এই-সব মরুচারীদের মারা যায় এত অত্যন্ত সহজে, ফিরে মার খাওয়ার আশঙ্কা এতই কম যে, মারের বাস্তবতা তাতেও ক্ষীণ হয়ে আসে । যাদের অতি নিরাপদে মারা সম্ভব মারওয়ালাদের কাছে তারা যথেষ্ট প্রতীয়মান নয় । এই কারণে, পাশ্চাত্য হননিবিদ্যা যারা জানে না তাদের মানবসত্তা আজ পশ্চিমের অস্ত্রীদের কাছে ক্রমশই অত্যন্ত ঝাপসা হয়ে আসছে । ইরাক বায়ুফৌজের ধর্মযাজক তাদের বায়ু-অভিযানের তরফ থেকে আমার কাছে বাণী চাইলেন, আমি যে বাণী পাঠালুম সেইটে এইখানে প্রকাশ করা যাক । From the beginning of our days man has imagined the seat of divinity in the