পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVV রবীন্দ্র-রচনাবলী আধুনিক ; নতুনকে তারা চিনতে আরম্ভ করেছে, পুরোনোকে তারা চেনে না। এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য এই যে, সকলেরই মধ্যে দেশ প্রকাশমান নয়, বহুর মধ্যে সে অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট । দেশের যথার্থ প্রকাশ কোনো কোনো বিশেষ মানুষের জীবনে ও উপলব্ধিতে । দেশের আন্তভীেম প্রাণধারা ভাবধারা অকস্মাৎ একটা-কোনাে ফাটল দিয়ে একট-কোনাে উৎসের মুখেই বেরিয়ে পড়ে। যা গভীরের মধ্যে সঞ্চিত তা সর্বত্র বহুলোকের মধ্যে উদঘাটিত হয় না। যা অধিকাংশের আবিল চিত্তের আড়ালে থাকে তা কারও কারও প্রকৃতিগত মানসিক স্বচ্ছতার কাছে সহজেই অভিব্যক্তি হয়। তার পুঁথিগত শিক্ষা কতদূর, ঠাকে দেশ মানে কি মানে না, সে কথা অবান্তর। সেরকম কোনো কোনো দৃষ্টিমান লোক পারস্যে নিশ্চয়ই আছে ; তারা সম্ভবত নামজাদাদের দলের মধ্যে নয়, এমন-কি, তারা বিদেশীদের কেউ হতেও পারে। কিন্তু পথিক মানুষ কোথায় তাদের খুঁজে পাবে। যার বাড়িতে আছি তার নাম মাহমুদ রেজা । তিনি জমিদার ও ব্যবসায়ী। নিজের ঘরদুয়োর ছেড়ে দিয়ে আমাদের জন্য দুঃখ পেয়েছেন কম নয়, নতুন আসবাবপত্র আনিয়ে নিজের অভ্যন্ত আরামের উপকরণকে উলটোেপালটা করেছেন । আড়ালে থেকে সমস্তক্ষণ আমাদের প্রয়োজনসাধনে তিনি ব্যস্ত, কিন্তু সর্বদা সমুখে এসে সামাজিকতার অভিঘাতে আমাদের ব্যস্ত করেন না। ঐর বয়স অল্প, শান্ত প্রকৃতি, সর্বদা কর্মপরায়ণ । সম্মানের সমারোহ এসে অবধি নানা আকারে চলেছে। এই জিনিসটাকে আমার মন সম্পূৰ্ণ গ্ৰহণ করতে পারে না, নিজের মধ্যে আমি এর হিসাব মিলিয়ে পাই নে । বুশেয়ারের এই জনতার মধ্যে আমি কেই-বা। আমার ব্যক্তিগত ইতিহাসে ভাষায় ভাবে কর্মে আমি যে বহুদূরের অজানা মানুষ । যুরোপে যখন গিয়েছি তখন আমার কবির পরিচয় আমার সঙ্গেই ছিল । একটা বিশেষ বিশেষণে তারা আমাকে বিচার করেছে । বিচারের উপকরণ ছিল তাদের হাতে । এরাও আমাকে কবি বলে জানে, কিন্তু সে জানা কল্পনায় ; এদের কাছে আমি বিশেষ কবি নই, আমি কবি । অর্থাৎ কবি বলতে সাধারণত এরা যা বােঝে। তাই সম্পূর্ণ আমার পরে আরোপ করতে এদের বাধে নি। কাব্য পারসিকদের নেশা, কবিদের সঙ্গে এদের আন্তরিক মৈত্রী । আমার খ্যাতির সাহায্যে সেই মৈন্ত্ৰী আমি কোনো দান না দিয়েই পেয়েছি । অন্য দেশে সাহিত্যরসিক মহলেই সাহিত্যিকদের আদর, পলিটিশিয়ানদের দরবারে তার আসন পড়ে না, এখানে সেই গাভী দেখা গেল না । ধারা সম্মানের আয়োজন করেছেন তারা প্ৰধানত রাজদরবারীদের দল। মনে পড়ল ঈজিস্টের কথা । সেখানে যখন গেলেম রাষ্ট্রনেতারা আমার অভ্যর্থনার জন্যে এলেন । বললেন, এই উপলক্ষে তাদের পার্লামেন্টের সভা কিছুক্ষণের জন্যে মুলতুবি রাখতে হল। প্ৰাচ্যজাতীয়ের মধ্যেই এটা সম্ভব। এদের কাছে আমি শুধু কবি নই, আমি প্রাচ্য কবি । সেইজন্যে এরা অগ্রসর হয়ে আমাকে সম্মান করতে স্বভাবত ইচ্ছা করেছে কেননা সেই সম্মানের ভাগ এদের সকলেরই। পারসিকদের কাছে আমার পরিচয়ের আরো-একটু বিশিষ্টতা আছে । আমি ইন্ডো-এরিয়ান । প্রাচীন ঐতিহাসিক কাল থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত পারস্যে নিজেদের আর্য-অভিমানবোধ বরাবর চলে এসেছে, সম্প্রতি সেটা যেন আরো বেশি করে জেগে ওঠবার লক্ষণ দেখা গেল । এদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্বন্ধ । তার পরে এখানে একটা জনশ্রুতি রটেছে যে, পারসিক মরমিয়া কবিদের রচনার সঙ্গে আমার লেখার আছে সাজাত্য । যেখানে পাঠকের কাছে কবিকে নিজের পথ নিজে অবারিত করে যেতে হয়। সেখানে ভূমি বন্ধুর। কিন্তু যে দেশে আমার পাঠক নেই এখানে আমি সেই নিরাপদ দেশের কৰি, এখানকার বহুকালের সকল কবিরই রাজপথ আমার পথ । আমার শ্ৰীতির দিক থেকেও এরা আমার কাছে এসেছে সহজ মানুষের সম্বন্ধে- এরা আমার বিচারক নয়, বন্ত যাচাই করে মূল্য দেনাপাওনার কারবার এদের সঙ্গে নেই। কাছের মানুষ বলে এরা যখন আমাকে অনুভব করেছে তখন ভুল করে নি। এরা, সত্যই সহজেই এদের কাছে এসেছি। বিনা বাধায় এদের কাছে আসা সহজ, সেটা স্পষ্টই অনুভব করা গেল। এরা যে অন্য সমাজের, অন্য ধৰ্মসম্প্রদায়ের, অন্য সমাজগাওঁীর, সেটা আমাকে মনে করিয়ে দেবার মতো কোনো উপলক্ষই আমার