পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে هوا গোচর হয় নি। যুরোপীয় সভ্যতায় সামাজিক বাধা নিয়মের বেড়া, ভারতীয় হিন্দুসভ্যতায় সামাজিক সংস্কারের বেড়া আরো কঠিন । বাংলায় নিজের কোণ থেকে বেরিয়ে পশ্চিমেই যাই, দক্ষিণেই যাই, কারও ঘরের মধ্যে আপন স্থান করে নেওয়া দুঃসাধ্য, পায়ে পায়ে সংস্কার বাচিয়ে চলতে হয় এমন-কি, বাংলার মধ্যেও । এখানে অশনে আসনে ব্যবহারে মানুষে মানুষে সহজেই মিশে যেতে পারে। এরা আতিথেয় বলে বিখ্যাত, সে আতিথ্যে পঙক্তিভেদ নেই। ১৬ এপ্ৰেল । সকাল সাতটার সময় শিরাজ অভিমুখে ছাড়বার কথা । শরীর যদিও অসুস্থ ও ক্লান্ত তবু অভ্যাসমত ভোরে উঠেছি, তখন আর-সকলে শয্যাগত । সকলে মিলে প্ৰস্তুত হয়ে বেরতে নট পেরিয়ে গেল । মেঠো রাস্তা । মোটরগাড়ির চালচলনের সঙ্গে রান্তাটার ভঙ্গিমার বনিবনাও নেই । সেই অসামঞ্জস্যের ধাক্কা যাত্রীরা প্ৰতি মুহুর্তে বুঝেছিল । যাকে বলে হাড়ে হাড়ে বোঝা । মাঠের পর মাঠ, তার আর শেষ নেই। কোথাও একটা ঘর বা গাছ বা বসতির চিহ্ন দেখি নে । পারস্যদেশের বেশির ভাগ উচ্চ মালভূমি, পাহাড়ে বেষ্টিত, আবার মাঝে মাঝে গিরি শ্রেণী । এই মালভূমি সমুদ্র-উপরিতল থেকে পাঁচ-ছয় হাজার ফিট উচু। এর মাঝখানটা নেমে গিয়েছে প্ৰকাণ্ড এক মরুভূমিতে । এই অধিত্যকায় পাহাড় ডিঙিয়ে মেঘ পেঁৗছতে বাধা পায় । বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অতি অল্প । পর্বত থেকে জলস্রোত নেমে মাঝে মাঝে উর্বরতা সৃষ্টি করে । কিন্তু ক্ষীণজল এই স্রোতগুলি সমুদ্র পর্যন্ত প্ৰায় পৌছয় না, মরু নেয় তাদের শুষে কিংবা জলার মধ্যে তাদের দুৰ্গতি ঘটে । বন্ধুর পথে নাড়া খেতে খেতে ক্ৰমে সেই বিশাল নীরস শূন্যতার মধ্যে দূরে দেখা যায় খেজুরেল কুঞ্জ, কোথাও-বাঁ বাবলা । এই জনবিরল জায়গায় দশ মাইল অন্তর সশস্ত্ৰ পুলিস পাহারা । পথে পথিক প্রায় দেখি নে । আমাদের দেশ হলে আর্তনাদমুখর গোরুর গাড়ি দেখা যেত। এ দেশে তার জায়গায় পিঠের দুই পাশে বোঝা বুলিয়ে গাধা কিংবা দল-বাধা খচ্চর, মাঝে মাঝে ভেড়ার পাল নিয়ে মেষপালক, দুই-এক জায়গায় কাটাঝোপের মধ্যে চরে বেড়াচ্ছে উটের দল । বেলা যায়, রৌদ্র বেড়ে ওঠে । মোটর-চক্রোৎক্ষিপ্ত ধুলো উড়িয়ে বাতাস বইছে, আমাদের শীতের হাওয়ার মতো ঠাণ্ডা । কচিৎ এক-এক জায়গায় দেখি তোরণাওয়ালা মাটির ছোটাে কেল্লা, সেখানে মোটর দাড় কুরিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হয় । ডান দিগন্তে একটা পাহাড়ের চেহারা ফুটে উঠেছে, যাত্রা-আরম্ভে আকাশের ঘোলা নীলের মধ্যে এ পাহাড় অবগুষ্ঠিত ছিল । এই অঞ্চলটায় বাষক্রি জাতের বাস, তাদের ভাষা তুর্কি । পূর্বতন রাজার আমলে এখানে তাদের বসতি পত্তন হয় । এদের ব্যাবসা ছিল দস্যবৃত্তি । নূতন আমলে এদের ঠাণ্ডা করা হচ্ছে । শোনা গোল কিছুদিন আগে পথের মধ্যে এরা একটা সঁাকো ভেঙে রেখেছিল। মালবোঝাই মোটরবাস উলটে পড়তেই খুনজখম লুটপাট করে । এই ঘটনার পরে রাজা তাদের প্রধানের ছেলেকে জামিনস্বরূপে তেহেরানে নিয়ে রেখেছেন । শান্তিটা কঠোর নয়, অথচ কেজো । এই জাতের দলপতি শাকরুল্লা খা তার বসতিগ্রাম থেকে এসে আমাদের অভিবাদন জানিয়ে গেলেন । আর কয়েক বছর আগে হলে এই অভিবাদনের ভাষা সম্পূৰ্ণ অন্যরকম হত, যাকে বলা যেতে পারত মর্মগ্রাহী । বুশেয়ার থেকে বরাবর আমাদের গাড়ির আগে আগে আর-একটি মোটরে বন্দুকধারী পাহারা চলেছে। প্ৰথমে মনে করেছিলুম বুঝি-বা এটা রাজকায়দার বাহুল্য অলংকার, এখন বোধ হচ্ছে এর একটি জরুরি অর্থ থাকতেও পারে। মেটে রান্তা ক্রমে নুড়ি-বিছানো হয়ে এল । বোঝা যায় পাহাড়ের বুকে উঠছি। পথের প্রান্তে কোথাও-বা গিরিনদী চলেছে পাথরের মধ্য দিয়ে পথ কেটে । কিন্তু তারা তো লোকালয়ের ধাত্রীর কাজ করছে না । মানুষ কোথায় । মাঠে মাঝে মাঝে আকন্দগাছ কুলগাছ উইলো- মাঝে মাঝে গমের খেতে চাষের পরিচয় পাই, কিন্তু চাষীর পরিচয় পাই নে । মধ্যাহ্ন পেরিয়ে যায় । শিরাজের পথ দীর্ঘ। এক দিনে যেতে কষ্ট হবে বলে স্থির হয়েছে খজেরুনে গবর্নরের আতিথ্যে মধ্যাহ্নভোজন সেরে রাত্ৰিষাপন করব । কিন্তু বিলম্বে বেরিয়েছি, সময়মত সেখানে