পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রাশিয়ার নূতন রাজদূত রাষ্ট্রস্টাইন এসে এই লেখাপড়া করে দিলেন যে, এত কাল সাম্রাজ্যিক রাশিয়া পারস্যের বিরুদ্ধে যে দলননীতি প্রবর্তন করেছিল সোভিয়েট গবর্মেন্ট তা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে প্ৰস্তুত । পারস্যের যে-কোনো স্বত্ব রাশিয়ার কবলে গিয়েছিল সমান্তই তারা ফিরিয়ে দিচ্ছেন ; রাশিয়ার কাছে পারস্যের যে ঋণ ছিল তার থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হল এবং রাশিয়া পারস্যে যে-সামন্ত পথ বন্দর প্রভৃতি স্বয়ং নির্মাণ করেছিল। কোনো মূল্য দাবি না করে সে সমন্তের স্বত্বই পারস্যকে অৰ্পণ করা হল । রেজা খা প্ৰথমে সামরিক বিভাগের মন্ত্রী, তার পরে প্রধান মন্ত্রী, তার পরে প্রজাসাধারণের অনুরোধে রাজা হলেন । তার চালনায় পারস্য অন্তরে বাহিরে নূতন বলে বলিষ্ঠ হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রে নানা বিভাগে যে-সকল বিদেশীর অধ্যক্ষতা ছিল তারা একে একে গেছে সরে । শোষণ-লুণ্ঠন-বিভ্রাটের শান্তি হয়ে এল, সমস্ত দেশ জুড়ে আজ কড়া পাহারা দাড়িয়ে আছে তর্জনী তুলে । উদভ্ৰান্ত পারস্য আজ নিজের হাতে নিজেকে ফিরে পেয়েছে । জয় হােক রেজা শা। পহিলবীর । ঐাদের কাছে আর-একটা খবর পাওয়া গেল, দেশের টাকা বাইরে যেতে দেওয়া হয় না । বিদেশ থেকে যারা কারবার করতে আসে সমান মূল্যের জিনিস এখান থেকে না কিনলে তাদের মাল বিক্রি বন্ধ । আমদানি রফতানির মধ্যে অসাম্য না থাকে সেই দিকে দৃষ্টি । 8 আমার শরীর ক্লান্ত তাই রাত্রের আহার একলা আমার ঘরে পাঠাবেন বলে ঐরা ঠিক করেছিলেন । রাজি হলুম না । বাগানে গাছতলায় দীপের আলোকে সকলের সঙ্গে খেতে বসলুম। এখানকার দেশী ভোজ্য । পোলাও কাবাব প্রভৃতিতে আমাদের দেশের মোগলাই খানার সঙ্গে বিশেষ প্ৰভেদ দেখা গেল बन्म ! ক্লান্ত শরীরে শুতে গেলুম । যথারীতি ভোরের বেলায় প্ৰস্তুত হযে যখন দরজা খুলে দিয়েছি তখন দুটি-একটি পাখি ডাকতে আরম্ভ করেছে । যাত্রা যখন আরম্ভ হল। তখন বেলা সাড়ে-সাতটা । বাইরে আফিমের খেতে ফুল ধরেছে। গেটের সামনে পথের ওপারে দোকান খুলেছে সবেমাত্র । সুন্দর সিন্ধ সকালবেলা । বা ধারে নিবিড় সবুজবর্ণ দাড়িমের বন— গমের খেত, তাতে নতুন চারা উঠেছে । এ বৎসর দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে ফসলে তেজ নেই, তবু এ জায়গাটি তুণে গুলেক্স রোমাঞ্চিত । উপলবিকীর্ণ পথে ঠোকর খেতে খেতে গাড়ি চলেছে । উচু পাহাড়ের পথ অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমিতে এসে নামল । অন্যত্র সাধারণত নগরের কিছু আগে থাকতেই তার উপক্ৰমণিকা দেখা যায়, এখানে তেমন নয়, শূন্য মাঠের প্রান্তে অকস্মাৎ শিরাজ বিরাজমান । মাটির তৈরি পাচিলগুলোর উপর থেকে মাঝে মাঝে চোখে পড়ল পপলার কমললেবু চেস্টনাট এলম গাছের মাথা । শিরাজের গবর্নর আমাকে সমারোহ করে নিয়ে গেলেন এক বড়ো বাড়িতে সভাগহে । কাপেট-পাতা মন্ত ঘর । দুই প্ৰান্তের দেয়াল-বরাবর অভ্যাগতেরা বসেছেন, তাদের সামনে ফলমিষ্টান্নসহযোগে চায়ের সরঞ্জাম ছোটো ছোটো টেবিলে সাজানো । এখানে শিরাজের সাহিত্যিকদল ও নানা শ্রেণীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত । শিরাজ-নাগরিকদের হয়ে একজন যে অভিবাদন পাঠ করলেন তার মর্ম এই:- শিরাজ শহর দুটি চিরজীবী মানুষের গৌরবে গৌরবান্বিত । তাদের চিত্তের পরিমণ্ডল তোমার চিত্তের কাছাকাছি । যে উৎস থেকে তোমার বাণী উৎসারিত সেই উৎসধারাতেই এখানকার দুই কবিজীবনের পুস্পকানন অভিষিক্ত । যে সাদির দেহ এখানকার একটি পবিত্র ভূখণ্ডতলে বহু শতাব্দীকাল চিরবিশ্রামে শিয়ান তার আত্মা আজ এই মুহুর্তে এই কাননের আকাশে উধের্ণ উখিত, এবং এখনই কবি হাফেজের পরিতৃপ্ত হাস্য তার স্বদেশবাসীর আনন্দের মধ্যে পরিব্যাপ্ত । আমি বললেম, যথোচিতভাবে আপনাদের সৌজন্যের প্রতিযোগিতা করি এমন সম্ভাবনা নেই ।