পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8S রবীন্দ্র-রচনাবলী তিনটি পারসিক ভদ্রলোক তেহেরান থেকে এসেছেন আমাদের পথের সুবিধা করে দেবার জন্যে । ঐদের মধ্যে একজন আছেন তিনি পররা বিভাগীয় মীর ভাই ফেব্রুঘি । সকলে বলেন ইনি ফিলজফার ; সৌম্য শান্ত ঐার মূর্তি। ইনি ফ্রেঞ্চ জানেন, কিন্তু ইংরেজি জানেন না। তবু কেবলমাত্র সংসর্গ থেকে ঐার নীরব পরিচয় আমাকে পরিতৃপ্তি দেয়। ভাষার বাধায় যে-সব কথা ইনি বলতে পারলেন না, অনুমানে বুঝতে পারি সেগুলি মূল্যবান। ইনি। আশা প্রকাশ করলেন আমার পারস্যে আসা সার্থক হবে। আমি বললুম, আপনাদের পূর্বতন সূফীসাধক কবি ও রূপকার ধারা আমি তাদেরই আপন, এসেছি আধুনিক কালের ভাষায়ে ; তাই আমাকে স্বীকার করা আপনাদের পক্ষে কঠিন হবে না। কিন্তু নূতন কালের যা দান তাকেও আমি অবজ্ঞা করি নে। এ যুগে য়ুরোপ যে সত্যের বাহনরূপে এসেছে তাকে যদি গ্ৰহণ করতে না পারি তা হলে তার আঘাতকেই গ্ৰহণ করতে হবে । তাই বলে নিজের আন্তরিক ঐশ্বর্যকে হারিয়ে বাহিরের সম্পদকে গ্ৰহণ করা যায় না । যে দিতে পারে সেই নিতে পারে, ভিক্ষুক তা পারে না । আজ সকালে হাফেজের সমাধি হয়ে বাগানবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেবার কথা । তার পূর্বে গবর্নরের সঙ্গে এখানকার রাজার সম্বন্ধে আলাপ হল । একদা রেজা শা ছিলেন। কসাক সৈন্যদলের অধিপতি মাত্র । বিদ্যালয়ে যুরোপের শিক্ষা তিনি পান নি, এমন-কি, পারসিক ভাষাতেও তিনি কাচা । আমার মনে পড়ল আমাদের আকবর বাদশাহের কথা । কেবল যে বিদেশীর কবল থেকে তিনি পারস্যকে বাচিয়েছেন তা নয়, মোল্লাব্দের-অধিপত্যজালে-দৃঢ়বদ্ধ পারস্যকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্ৰতন্ত্রকে প্রবল ও আচল বাধা থেকে উদ্ধার করেছেন । আমি বললুম, দুৰ্ভাগা ভারতবর্ষ, জটিল ধর্মের পাকে আপাদমস্তক জড়ীভূত ভারতবর্ষ । অন্ধ আচারের বোঝার তলে পঙ্গু আমাদের দেশ, বিধিনিষেধের নিরর্থকতায় শতধাবিভক্ত আমাদের 38 গবর্নর বললেন, সাম্প্রদায়িক ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে যতদিন না ভারত একান্ম হবে ততদিন গোলটেবিল বৈঠকে বরগ্রহণ করে তার নিষ্কৃতি নেই। অন্ধ যারা তারা ছাড়া পেলেও এগোয় না, এগোতে গেলেও মরে গর্তে পড়ে । অবশেষে হাফেজের সমাধি দেখতে বেরলুম ; নূতন রাজার আমলে এই সমাধির সংস্কার চলছে। পুরোনো কবরের উপর আধুনিক কারখানায় ঢালাই-করা জালির কাজের একটা মণ্ডপ তুলে দেওয়া হয়েছে । হাফেজের কাব্যের সঙ্গে এটা একেবারেই খাপ খায় না । লোহার বেড়ায় ঘেরা কবি-আত্মাকে মনে হল যেন আমাদের পুলিসরাজত্বের অর্ডিনান্সের কয়েদী । ভিতরে গিয়ে বসলাম । সমাধিরক্ষক একখানি বড়ো চৌকো আকারের বই এনে উপস্থিত করলে । সেখানি হাফেজের কাব্যগ্রন্থ । সাধারণের বিশ্বাস এই যে, কোনো একটি বিশেষ ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বুজে এই গ্রন্থ খুলে যে কবিতাটি বেরবে তার থেকে ইচ্ছার সফলতা নির্ণয় হবে । কিছু আগেই গবর্নরের সঙ্গে যে বিষয় আলোচনা করেছিলুম। সেইটেই মনে জাগছিল । তাই মনে মনে ইচ্ছা করলুম। ধর্মনামধারী অন্ধতার প্রাণাস্তিক ফাস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায় । যে পাতা বেরল তার কবিতাকে দুই ভাগ করা যায় । ইরানী ও কয়জনে মিলে যে তৰ্জমা করেছেন তাই গ্রহণ করা গেল । প্ৰথম অংশের প্রথম শ্লোকটি মাত্র দিই । কবিতাটিকে রূপকভাবে ধরা হয়, কিন্তু সরল অর্থ ধরলে সুন্দরী প্ৰেয়সীই কাব্যের উদ্দিষ্ট । প্ৰথম অংশ। মুকুটধারী রাজারা তোমার মনোমোহন চক্ষুর দাস, তোমার কণ্ঠ থেকে যে সুধা নিঃসৃত হয় জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমানেরা তার দ্বারা অভিভূত । দ্বিতীয় অংশ। স্বৰ্গদ্বার যাবে খুলে, আর সেইসঙ্গে খুলবে। আমাদের সমস্ত জটিল ব্যাপারের গ্রন্থি, এও কি হবে সম্ভব । অহংকৃত ধাৰ্মিকনামধারীদের জন্যে যদি তা বন্ধই থাকে। তবে ভরসা রেখে মনে ঈশ্বরের নিমিত্তে তা যাবে খুলে ।