পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে Ꮼ8Ꮼ বন্ধুরা প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের সংগতি দেখে বিস্মিত হলেন। এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল, এখানকার এই বসন্তাপ্ৰভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হস্যোেজল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি। আচারনিষ্ঠ ধাৰ্মিকদের কুটিল ভুকুটি । তাদের বচনজালে আমাকে বাধতে পারে নি ; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায় । নিশ্চিত মনে হল আজি, কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক । ভরপুর মন নিয়ে বাগানবাড়িতে এলুম। র্যার বাড়ি তার নাম শিরাজী । কলকাতায় ব্যাবসা করেন। র্তারই ভাইপো খলিলী আতিথ্যভার নিয়েছেন। পরিষ্কার নতুন বাড়ি, সামনেট খোলা, অদূরে একটি ছােটাে পাহাড়। কঁাচের শাসির মধ্যে দিয়ে প্রচুর আলো এসে সুসজ্জিত ঘর উজ্জ্বল করে রেখেছে। প্ৰত্যেক ঘরেই ছোটাে ছোটাে টেবিলে বাদাম কিশমিশ মিষ্টান্ন সাজানো। চা খাওয়া হলে পর এখানকার গান-বাজনার কিছু নমুনা পেলুম । একজনের হাতে কানুন, একজনের হাতে সেতারজাতীয় বাজনা, গায়কের হাতে তাল দেবার যন্ত্র- বায়া-তবলার একত্রে মিশ্রণ। সংগীতের তিনটি ভাগ । প্ৰথম অংশটা চটুল, মধ্য অংশ ধীরমন্দ সকরুণ, শেষ অংশটা নাচের তালে। আমাদের দিশি সুরের সঙ্গে স্থানে স্থানে অনেক মিল দেখতে পাই । বাংলাদেশের সঙ্গে একটা ঐক্য দেখছি- এখানকার সংগীত কাব্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয় । ইশফাহানে যাত্রা করবার পূর্বে বিশ্রাম করে নিচ্ছি। বসে আছি দোতলার মাদূর-পাতা লম্বা বারান্দায় । সম্মুখপ্রান্তে রেলিঙের গায়ে গায়ে টবে সাজানো পুম্পিত জেরেনিয়ম । নীচের বাগানে ফুলের কেয়ারির মাঝখানে ছোটাে জলাশয়ে একটি নিক্রিয় ফোয়ারা, আর সেই কেয়ারিকে প্ৰদক্ষিণ করে কলশব্দে জলস্রোত বয়ে চলেছে। অদূরে বনস্পতির বীথিকা । আকাশে পাণ্ডুর নীলিমার গায়ে তরুহীন বলি-অঙ্কিত পাহাড়ের তরঙ্গায়িত ধূসর রেখা। দূরে গাছের তলায় কারা একদল বসে গল্প করছে । ঠাণ্ডা হাওয়া, নিস্তািন্ধ মধ্যাহ্ন। শহর থেকে দূরে আছি, জনতার সম্পর্ক নেই, পাখিরা কিচিমিচি করে উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের নাম জানি নে । সঙ্গীরা শহরে কে কোথায় চলে গেছে, চিরক্লান্ত দেহ চলতে নারাজ তাই একলা বসে আছি। পারস্যে আছি সে কথা বিশেষ করে মনে করিয়ে দেবার কিছুই নেই। এই আকাশ, বাতাস, কম্পমান সবুজ পাতার উপর কম্পমান এই উজ্জ্বল আলো, আমারই দেশের শীতকালের মতো । শিরাজ শহরটি যে প্রাচীন তা বলা যায় না । আরবেরা পারস্য জয় করার পরে তবে এই শহরের উদ্ভব । সাফাবি-শাসনকালে শিরাজের যে শ্ৰীবৃদ্ধি হয়েছিল আফগান আক্রমণে তা ধ্বংস হয়ে যায় । আগে ছিল শহর ঘিরে পাথরের তোরণ, সেটা ভূমিসাৎ হয়ে তার জায়গায় উঠেছে মাটির দেয়াল । নিষ্ঠুর ইতিহাসের হাত থেকে পারস্য যেমন বরাবর আঘাত পেয়েছে পৃথিবীতে আর-কোনো দেশ এমন পায় নি, তবু তার জীবনীশক্তি বার বার নিজের পুনঃসংস্কার করেছে। বর্তমান যুগে আবার সেই কাজে সে লেগেছে, জেগে উঠেছে আপন মূৰ্ছিত দশা থেকে । (? চলেছি। ইস্ফাহানের দিকে । বেলা সাতটার পর শিরাজের পুরস্কার দিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। গিরিশ্রেণীর মধ্য দিয়ে চলা শুরু হল। পিছনে তাকিয়ে মনে হয় যেন গিরিপ্ৰকৃতি শিলাঞ্জলিতে শিরাজকে অর্ঘ্যরাপে ঢেলে দিয়েছে । শিরাজের বাইরে লোকালয় একেবারে অন্তহিঁত, তার পরিশিষ্ট কিছুই নেই, গাছপালাও দেখা যায়