পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

2ܪ G SVL পারস্যে পৃষ্ঠায়- খবরের কাগজের প্যারাগ্রাফে নয় । গবর্নরের ব্যবস্থায় এ দুইদিন রাত্রির আহারের পর ঘণ্টাখানেক ধরে এখানকার সংগীত শুনতে পাই । বেশ লাগে । টার বলে যে তারের যন্ত্র, অতি সূক্ষ্ম মৃদুধ্বনি থেকে প্রবল ঝংকার পর্যন্ত তার গতিবিধি । তাল দেবার যন্ত্রটাকে বলে ডম্বক, তার বোলের আওয়াজে আমাদের বায়া-তবলার চেয়ে বৈচিত্ৰ্য আছে । ইস্পাহানে আজ আমার শেষদিন, অপরাহুে পুরসভার তরফ থেকে আমার অভ্যর্থনা । যে প্রাসাদে আমার আমন্ত্রণ সে শা-আকবাসের আমলের, নাম চিহিল সতুন । সমুচ্চ পাথরের স্তম্ভশ্রেণীবিরাজিত এর অলিন্দ, পিছনে সভামণ্ডপ, তার পিছনে প্রশস্ত একটি ঘর- দেয়ালে বিচিত্র ছবি আঁকা । এক সময়ে কোনো-এক কদুৎসাহী শাসনকর্তা চুনকাম করে সমস্তটা ঢেকে দিয়েছিলেন । হাল আমলে ছবিগুলিকে আবার প্রকাশ করা হচ্ছে । এখানকার কাজ শেষ হল । দৈবাৎ এক-একটি শহর দেখতে পাওয়া যায় যার স্বরূপটি সুস্পষ্ট, প্রতি মুহুর্তে যার সঙ্গে পরিচয় ঘটতে থাকে । ইস্পাহান সেইরকম শহর । এটি পারস্যদেশের একটি পীঠস্থান । এর মধ্যে বহুযুগের, শুধু শক্তি নয়, প্ৰেম সজীব হয়ে আছে । ইস্পাহান পারস্যের একটি অতি প্ৰাচীন শহর । একজন প্রাচীন ভ্ৰমণকারীর লিখিত বিবরণে পাওয়া যায় সেলজুক-রাজবংশীয় সুলতান মহম্মদের মাদ্রাসা ও সমাধির সম্মুখে তখন একটি প্রকাণ্ড দেবমূর্তি পড়ে ছিল । কোনো-একজন সুলতান ভারতবর্ষ থেকে এটি এনেছিলেন । তার ওজন ছিল প্ৰায় হাজার

  • s ।

দশ শতাব্দীর শেষভাগে সম্রাট শা আকবাস আর্দাবিল থেকে তার রাজধানী এখানে সরিয়ে নিয়ে আসেন । সাফাবি-বংশীয় এই শা আকাবাস পৃথিবীর রাজাদের মধ্যে একজন স্মরণীয় ব্যক্তি । তিনি যখন সিংহাসনে উঠলেন তখন তার বয়স ষোলো, ষাট বছর বয়সে তার মৃত্য । যুদ্ধবিপ্লবের মধ্য দিয়েই তার রাজত্বের আরম্ভ । সমস্ত পারস্যকে একীকরণ এর মহৎকীর্তি । ন্যায়বিচারে দক্ষিণো ঐশ্বত্বে তার খ্যাতি ছিল সর্বত্র পরিব্যাপ্ত । তার ঔদার্য ছিল অনেকটা দিল্লীশ্বর আকবরের মতো । তারা এক সময়ের লোকও ছিলেন । তার রাজত্বে পরধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি উৎপীড়ন ছিল না । কেবল শাসননীতি নয়, তার সময়ে পারস্যে স্থাপত্য ও অন্যান্য শিল্পকলা সর্বোচ্চসীমায় উঠেছিল । ৪৩ বৎসর রাজত্বের পর তার মৃত্যু হয় । তার মৃত্যুর সঙ্গে তার মহিমার অবসান । অবশেষে একদা তার শেষ বংশধর শা। সুলতান হােসেন পারস্যবিজয়ী সুলতান মামুদের আসনতলে প্ৰণতি করে বললেন, ‘পুত্র, যেহেতু জগদীশ্বর আমার রাজত্ব আর ইচ্ছা করেন না, অতএব আমার সাম্রাজ্য এই তোমার হাতে সমৰ্পণ করি ।” এর পর আফগান রাজত্ব । শাসনকর্তাদের মধ্যে হত্যা ও গুপ্তহত্যা এগিয়ে চলল। চারি দিকে লুটপাট ভাঙাচোরা । অত্যাচারে জর্জরিত হল ইস্পাহান । অবশেষে এলেন নাদির শা। বাল্যকালে ছাগল চরাতেন ; অবশেষে একদিন ভাগ্যের চক্রান্তে আফগান ও তুর্কিদের তাড়িয়ে দিয়ে এই রাখাল চড়ে বসলেন শা আকবাসের সিংহাসনে । তার জয়পতাকা দিল্লি পর্যন্ত উড়ল । স্বরাজ্যে যখন ফিরলেন সঙ্গে নিয়ে এলেন বহুকোটি টাকা দামের লুটের মাল ও ময়ূরত্যক্ত সিংহাসন । শেষবয়সে তার মেজাজ গেল বিগড়ে, আপনি বড়োছেলের চোখ উপড়িয়ে ফেললেন । মাথায় খুন চড়ল । অবশেষে নিদ্রিত অবস্থায় তাবুর মধ্যে প্ৰাণ দিলেন তার কোনো এক অনুচরের ছুরির ঘায়ে ; শেষ হয়ে গেল বিজয়ী রাজমহিমা আখ্যাত মৃত্যুশয্যায় । তার পরে অর্ধশতাব্দী ধরে কড়াকড়ি, খুনোখুনি, চোখ-ওপড়ানো । বিপ্লবের আবর্তে রক্তাক্ত রাজমুকুট লাল বুদবুদের মতো ক্ষণে ক্ষণে ফুটে ওঠে। আর ফেটে যায়। কোথা থেকে এল কাজার-বংশীয় তুর্কি আগা মহম্মদ খা । খুন করে, লুঠ করে, হাজার হাজার নারী ও শিশুকে বন্দী করে আপন পাশবিকতার চূড়ো তুললে কর্মান শহরে, নগরবাসীর সত্তর হাজার উৎপাটিত চোখ হিসাব করে