পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে Wy6 আজ অপরাঢ়ে আমার নিমন্ত্রণ এখানকার সাহিত্যিকদের তরফ থেকে । বাগানের গাছের ছায়ায় আমাদের আসন । ছোটো ছোটো টেবিলে চায়ের আয়োজন জনতার মধ্যে বিক্ষিপ্ত । একে একে নানা লোকে তাদের অভিনন্দন পাঠ শেষ করলে সেই বৃদ্ধ কবি ঠার কবিতা আবৃত্তি করলেন। বীজমন্দ ঠার ছন্দপ্রবাহ, আর উদাম তার ভঙ্গি । আমি তাদের বললেম, এমন কবিতার অর্থ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই ; এ যেন উত্তাল তরঙ্গিত সমুদ্রের বাণী, এ যেন ঝঞ্জাহত অরণ্যশাখার উদগাথা । অবশেষে আমার পালা উপস্থিত হতে আমি বললুম, আজ আমি একটি দরবার নিয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। একদা আরবের পরম গৌরবের দিনে পূর্বে পশ্চিমে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক ভূভাগ আরব্যের প্রভাব-অধীনে এসেছিল। ভারতবর্ষে সেই প্রভাব যদিও আজ রাষ্ট্রশাসনের আকারে নেই, তবুও সেখানকার বৃহৎ মুসলমান সম্প্রদায়কে অধিকার করে বিদ্যার আকারে, ধর্মের আকারে আছে। সেই দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে আমি আপনাদের বলছি, আরবসাগর পার করে আরব্যের নববাণী আর-একবার ভারতবর্ষে পাঠান- যারা আপনাদের স্বধৰ্মী তাদের কাছে- আপনাদের মহৎ ধর্মগুরুর পূজানামে, আপনাদের পবিত্রধর্মের সুনামী রক্ষার জন্য । দুঃসহ আমাদের দুঃখ, আমাদের মুক্তির অধ্যবসায় পদে পদে ব্যর্থ ; আপনাদের নবজাগ্ৰত প্ৰাণের উদার আহবান সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে, অমানুষিক অসহিষ্ণুতা থেকে, উদার ধর্মের অবমাননা থেকে, মানুষে মানুষে মিলনের পথে, মুক্তির পথে নিয়ে যাক হতভাগ্য ভারতবর্ষকে । এক দেশের কোলে যাদের জন্ম অন্তরে বাহিরে তারা এক হোক । রাজা আমাকে চায়ের নিমন্ত্ৰণ করেছেন নদীর ওপারে তার একটি বাগানবাড়িতে । রাজা একেবারেই আড়ম্বর-শূন্য মানুষ, অত্যন্ত সহজ ব্যবহার । খোলা চাতালে আমরা বসলুম, সামনে নীচে বাগান । রাজার ভাইও আছেন তার সঙ্গে । প্রধানমন্ত্ৰী আছেন- অল্প বয়স, এখানকার সবাই বলেন, আজ পৃথিবীতে সব চেয়ে অল্প বয়সের মন্ত্রী ইনি । যিনি দোভাষীর কাজ করবেন। তিনিও উপস্থিত।*।। রাজা বললেন, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের যে দ্বন্দ্ব বেধেছে নিশ্চয়ই সেটা ক্ষণিক । যখন কোনো দেশে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে উদবোধন আসে তখন প্ৰথম অবস্থায় তারা নিজেদের বিশিষ্টতা সম্বন্ধে অত্যন্ত বেশি সচেতন হয়ে ওঠে এবং সেইটেকে রক্ষা করবার জন্যে তাদের চেষ্টা প্ৰবল হয় । এই আকস্মিক বেগটা কমে গেলে মন আবার সহজ হয়ে আসে। আমি বললেম, আজ তুর্কি ঈজিপ্ট পারস্যে নবজাগ্ৰত জাতির যে পরিচয় আমরা পেয়েছি তাতে দেখলুম, যে বিশিষ্টতাবোধ সংকীর্ণভাবে আত্মনিহিত ও অন্যের প্রতি বিরুদ্ধ, সচেষ্টতার সঙ্গেই তার তীব্ৰতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, নইলে সেই অন্ধতার দ্বারা জাতির রাষ্ট্রবুদ্ধি অভিভূত হয় । ভারতবর্ষের উদবোধনে যদি সেই সৰ্ব্বজনের হিতজনক শুভবুদ্ধির আবির্ভাব দেখতে পেতেম তা হলে নিশ্চিন্ত হতেম । কিন্তু যখন দেখতে পাই হিন্দু-মুসলমান উভয়পক্ষেই শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মঘাতী ধর্মািন্ধতা প্রবল হয়ে উঠে রাষ্ট্রসংঘকে প্ৰতিহত করছে ७थन झूठा- झूठ श्य । এই বাগানের ধারে চায়ের টেবিলে সহজ বাক্যালাপের মধ্যে সেদিনের ছবি মনে আনা দুরূহ, যেদিন এই রাজা পথশূন্য মরুভূমির মধ্যে বেদুয়িনদের বহু উপজাতিকে আপনি নেতৃত্বের অধীনে এক করে নিয়ে জর্মানি ও তুরুস্কের সম্মিলিত অভিযানকে পদে পদে উদভ্ৰান্ত করে বিধ্বস্ত করেছিলেন। মৃত্যুর মূল্যে কিনেছিলেন জীবনের গীেরব । কঠিন ভীষণ সেই রণপ্রোঙ্গণ, জয়ে-পরাজয়ে নিতাসংশয়িত দুঃসাধ্য সেই অধ্যবসায় । সেই অক্লান্ত রণরঙ্গের অধিনায়ককে দেখলেম । তখনকার মৃত্যুচ্ছায়াক্রান্ত দিনরাত্রির সেই বিভীষিকার মধ্যে তার উবাহিনীর সঙ্গে কোথাও কোনো-একটা স্থান পাবার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু আজ বসেছি চায়ের টেবিলে এই নূতন ইতিহাসসৃষ্টিকর্তার পাশে সহজভাবে ; কেননা আমিও অন্য উপকরণ নিয়ে মানুষের ইতিহাসসৃষ্টিতে আপন শক্তি উৎসর্গ করেছি। সেই স্বতন্ত্র অথচ যথার্থ সহযোগিতার মূল্য যদি না এই বীর বুঝতে পারতেন। তবে তার যুদ্ধবিজয়ী শৌৰ্য আপন মূল্য অনেকখানি হারাত । কর্নেল লরেন্স বলেছেন, আরবের মহৎ লোকদের মধ্যে মহম্মদ ও সালাদিনের নীচেই রাজা ফয়সলের স্থান । এই মহত্বের সরলমূর্তি দেখেছি তার সহজ আতিথ্যে, এবং তাকে