পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዋff፭Q”ህ শরীরটার প্রতি করুণা করে না যাওয়াই ভালো । তার পরে মনে পড়ল একদা আস্ফালন করে লিখেছিলুম, ইহার চেয়ে হতেম। যদি আরব বেদুয়িনি।” তখন বয়স ছিল তিরিশের কাছ ঘেঁযে, সে তিরিশ আজ পিছনের দিগন্তে বিলীনপ্রায় । তা হােক, কবিতাটাকে কিছু পরিমাণে পরখ করে না এলে মনে পরিতাপ থাকবে। সকালে বেরিয়ে পড়লুম। পথের মধ্যে হঠাৎ নিয়ে গেল ট্রেনিং স্কুলের ছেলেদের মাঝখানে, হঠাৎ তাদের কিছু বলতেও হল। পথে পথে কত কথাই ছড়াতে হয়, সে পাকা ফল নয়, সে ঝরা পাতা, কেবলমাত্র ধুলোর দাবি মেটাবার জন্যে । তার পরে গাড়ি চলল মরুভূমির মধ্যে দিয়ে। বালুমারু নয়, শক্ত মাটি । মাঝে মাঝে নদী থেকে জল এনেছে নালা কেটে, তাই এখানে ওখানে কিছু কিছু ফসলের আভাস দেখা দিয়েছে। পথের মধ্যে দেখা গেল নিমন্ত্রণকর্তা আর-এক মোটরে করে চলেছেন, তাকে আমাদের গাড়িতে তুলে নেওয়া হল । শক্ত মানুষ, তীক্ষা চক্ষু ; বেদুয়িনী পোশাক । অর্থাৎ মাথায় একখণ্ড সাদা কাপড় ঘিরে আছে কালো বিড়ের মতো বক্সবেটনী । ভিতরে সাদা লম্বা আঙিয়া, তার উপরে কালো পাতলা জোকবা । আমার সঙ্গীরা বলেন, যদিও ইনি পড়াশুনো করেন নি বললেই হয়, কিন্তু তীক্ষবুদ্ধি। তিনি এখানকার পার্লামেন্টের একজন মেম্বর । রৌদ্রে ধূ-ধূ করছে ধূসর মাটি, দূরে কোথাও কোথাও মরীচিকা দেখা দিল। কোথাও মেষপালক নিয়ে চলেছে ভেড়ার পাল, কোথাও চরছে উট, কোথাও-বাঁ ঘোড়া । হু হু করে বাতাস বইছে, মাঝে মাঝে ঘুর খেতে খেতে ছুটেছে ধূলির আবর্ত। অনেকদূর পেরিয়ে ঐদের ক্যাম্পে এসে পৌঁছলুম। একটা বড়ো খােলা ঠাকুর মধ্যে দলের লোক বসে গেছে, কফি সিদ্ধ হচ্ছে, খাচ্ছে ঢেলে ঢেলে। আমরা গিয়ে বসলুম একটা মন্ত মাটির ঘরে। বেশ ঠাণ্ডা। মেঝেতে কার্পেট, এক প্রান্তে তক্তপোশের উপর গদি পাতা। ঘরের মাঝখান বেয়ে কাঠের থাম, তার উপরে ভর দিয়ে লম্বা লম্বা, খুঁটির পরে মাটির ছাদ । আমীয়বান্ধবেরা সব এদিকে-ওদিকে, একটা বড়ো কঁাচের গুড়গুড়িতে একজন তামাক টানছে । ছোটাে আয়তনের পেয়ালা আমাদের হাতে দিয়ে তাতে অল্প একটু করে কফি ঢাললে, ঘন কফি, কালো তেতো । দলপতি জিজ্ঞাসা করলেন আহার ইচ্ছা করি কি না, 'না' বললে আনবার রীতি নয়। ইচ্ছা করলেম, অভ্যন্তরে তাগিদাও ছিল। আহার আসবার পূর্বে শুরু হল একটু সংগীতের ভূমিকা। গোটাকতক কাঠির উপরে কোনোমতে চামড়-জড়ানো একটা তোড়াবাকা একতারা যন্ত্র বাজিয়ে একজন গান ধরলে। তার মধ্যে বেদুয়িনী তেজ কিছুই ছিল না। অত্যন্ত মিহিচড়া গলায় নিতান্ত কান্নার সুরে গান। একটা বড়ো জাতের পতঙ্গের রাগিণী বললেই হয় । ” অবশেষে সামনে চিলিমচি ও জলপাত্র এল। সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে প্রস্তুত হয়ে বসলুম। মেঝের উপর জাজিম পেতে দিলে। পূর্ণচন্দ্রের ডবল আকারের মোটা মোটা রুটি, হাতাওয়ালা অতি প্ৰকাণ্ড পিতলের থালায় ভাতের পর্বত আর তার উপর মন্ত এবং আন্ত একটা সিদ্ধ ভেড়া। দু-তিনজন জোয়ান বহন করে মেঝের উপর রাখলে। পূৰ্ববতী মিহি-করুণ রাগিণীর সঙ্গে এই ভোজের আকৃতি ও প্রকৃতির কোনো মিল পাওয়া যায় না । আহারাধীরা সব বসল। থালা ঘিরে। সেই এক থালা থেকে সবাই হাতে করে মুঠো মুঠো ভাত প্লেটে তুলে নিয়ে আর মাংস ছিড়ে ছিড়ে খেতে লাগল। ঘোল দিয়ে গেল পানীয়রূপে। গৃহকর্তা বললেন, আমাদের নিয়ম এই যে, অতিথিরা যতক্ষণ আহার করতে থাকে আমরা অভুক্ত দাড়িয়ে থাকি, কিন্তু সময়াভাবে আজ সে নিয়ম রাখা চলবে না। তাই অদূরে আর-একটা প্ৰকাণ্ড থালা পড়ল । তাতে তারা স্বজনবৰ্গ বসে গেলেন । যে অতিথিদের সন্মান অপেক্ষাকৃত কম আমাদের ভুক্তাবশেষ তাদের ভাগে পড়ল। এইবার হল নীচের ফরমাশ । একজন একঘেয়ে সুরে বাঁশি বাজিয়ে চলল, আর এরা তাল রাখলে লাফিয়ে লাফিয়ে। একে নাচ বললে বেশি। বলা হয়। যে ব্যক্তি প্রধান, হাতে একখানা রুমাল নিয়ে সেইটে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আগে আগে নাচতে লাগল, তারই কিঞ্চিৎ ভঙ্গির বৈচিত্ৰ্য ছিল। ইতিমধ্যে বউমা গেলেন এদের অন্তঃপুরে। সেখানে মেয়েরা তাকে নাচ দেখালেন, তিনি বলেন সে নাচের মতো নাচ বািট- বোঝা গেল যুরোপীয় নটীরা প্রাচ্য নাচের কায়দায় এদের অনুকরণ করে, কিন্তু সম্পূর্ণ রস দিতে পারে না। M M | R